রুহুল আমিন, যশোর প্রতিনিধি
যশোর সদরের নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের শালিয়াট গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে দুটিতে বসবাস করেন দুই পরিবার, অন্যটিতে তালা লাগানো। অপরদিকে, ফতেপুর ইউনিয়নের ভায়না-ধানঘাটা ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ১৩টি ঘর। যার মধ্যে মাত্র তিনটি ঘরে লোকজন থাকেন। বাকি ১০টিতেই লাগানো তালা। খালের পাশে রয়েছে ৫টি ঘর, যাতে দুই পরিবার থাকেন। অপর তিনটিতে তালা দেওয়া।
ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভায়না ধানঘাটা এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ১৮টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাউলিয়া এলাকায় রয়েছে ৩৪টি ঘর। সেখানে প্রত্যেকে পেয়েছেন ১ দশমিক ৭৬ শতক থেকে ২ শতক জমি। নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, শালিয়াট গ্রামে রয়েছে ৪৪ শতাংশ খাসজমি। সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিনজনকে, প্রত্যেক ঘরের জন্য ৪ শতক করে জমি। যদিও অন্যান্য এলাকায় জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৭৬ শতক থেকে দুই শতক করে। কিন্তু দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন এবং ছিন্নমূল মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণে বিগত সরকার ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ সেখানে ঘর না পাওয়ায় বেশিরভাগ ঘরই ফাঁকা রয়ে গেছে। আবার অনেক সচ্ছল মানুষ ঘর বরাদ্দ পাওয়ায় এসব ঘরে তারা ওঠেননি। ফলে বেশিরভাগ ঘরই রয়েছে ফাঁকা, তালাবদ্ধ। এতে করে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নওয়াপাড়া ইউনিয়নের শালিয়াট গ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন, শালিয়াট গ্রামের যে জায়গায় আশ্রয়ণের ঘর করে দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গার নাম ঘাটকূল। বিলের পাশে উঁচু এই জমিতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করত। বর্ষার সময় চাষিরা বিলের জমি থেকে ধান কেটে এই ঘাটকূলে রেখে পরে নিয়ে যেত যার যার বাড়ি। গ্রামের পানি বের হওয়ার একটাই উপায় ছিল এই ঘাটকূল। কিন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তৈরি এবং একজন বাসিন্দা সেই জায়গা অনৈতিকভাবে দখলে নেওয়ায় পানি নিষ্কাশনের কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে সামান্য বৃষ্টিতে গ্রামের পুরো পানি এখানে আটকে থাকে। ঘর বরাদ্দ পাওয়া আলেয়া বেগম (স্বামী জব্বার আলী) দুই সন্তান নিয়ে এখানে থাকেন। তিনি মূলত দিনমজুর, খোয়া ভেঙে সংসার চালান। জব্বার আলী শেখহাটি এলাকায় থাকেন।
ভূমি অফিস থেকে জানানো হয়, জব্বার আলীর নামে দুই শতক আর আলেয়া বেগমের নামে দুই শতক জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্য দুই পরিবারের লোকজনও একই পরিমাণ জমি পেয়েছেন। তৃতীয় ঘরটি যিনি পেয়েছেন, তিনি শহরেই থাকেন। এখানে কখনো থাকেননি।
জানতে চাইলে আলেয়া বেগম বলেন, এখানে জমি ও ঘর পাওয়ার (ঘর করতে তিনিও টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন) পর স্থানীয় লোকজন বেশ অত্যাচার শুরু করেছে। আড়াই বছরের মতো তিনি এখানে রয়েছেন। প্রথম দিকে ঠিকঠাক চললেও এখন গ্রামের লোকজন তাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আলেয়া বেগম বলেন, দলিলে ৪ শতক জমির কথা থাকলেও আমরা পেয়েছি কম। এখানে জমির পরিমাণ ৪৮ শতক। রাস্তা বাদে মোট ৭ জন জমি পেয়েছেন ৩২ শতক। ঘর রয়েছে তিনটি। অন্যরা টাকার অভাবে ঘর করতে পারেননি। একটি জমি ঘিরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ভাগনে মামুনের জমি ওইটা। সে শহরে থাকে, এই জমি তার নামে বরাদ্দ।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) শাহাদত হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের জমির পরিমাণ এবং এই অঞ্চলের জমির পরিমাণে একটু ফারাক রয়েছে। এটি ৮-৯ বছর আগে বরাদ্দ দেওয়া। যশোর সদরের ভায়না-ধানঘাটা ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এক বছরের অধিককাল বসবাস করেন আব্দুর রহিম (৪৫) নামে একজন ভ্যানচালক। এখানে রয়েছে ১৩টি ঘর। যার মধ্যে মাত্র তিনটি ঘরে লোকজন থাকেন। বাকি ১০টিতেই তালা লাগানো।
বরাদ্দ ঘরে লোকজন থাকেন না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রহিমের স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, ফাঁকা মাঠের মধ্যে ঘরবাড়ি। পরিবারগুলোর জন্য নেই কোনো টিউবওয়েল। ঘরে যাওয়ার জন্য নেই কোনো রাস্তা। যা আছে, তা প্রায় সবসময়ই পানি-কাদায় ভরা। সেখানকার বাসিন্দা রিকশাচালক আকবর মোল্ল্যা (৭২) বলেন, বৃষ্টিতে টিন ছাপিয়ে ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। ঘরগুলো দায়সারাভাবে করা হয়েছে। তিনি জানান, আব্দুস সালাম নামে একজন একটি ঘরে থাকেন। যদিও তার নামে কোনো বরাদ্দ নেই।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই বাড়িঘরের অনতিদূরে ধানঘাটা খালের (দাইতলা খাল) পাশেই রয়েছে আরও ৫টি ঘর। সেখানে থাকে দুই পরিবার। সনাতন ধর্মাবলম্বী পবিত্র সরদারের স্ত্রী বিধবা কুমারী রাণী (৬০)। তার সঙ্গে থাকেন ছেলে বাপ্পী সরদার ও তার স্ত্রী কাকলী রাণী সরদার। ঘর বরাদ্দ নেই, তবুও একটি ফাঁকা ঘরে থাকেন বেণুবালা (৭০)। সঙ্গে তার ছোট ছেলে। এই আবাসনের বাসিন্দারা জানান, বাকি তিন ঘর কারা বরাদ্দ পেয়েছেন জানা নেই। তারা কখনোই এখানে আসেননি। চলাচলের রাস্তার ভয়াবহ অবস্থা, পানীয় জলের সংকট, সাপ পোকামাকড়ের অবাধ বিচরণ-বেশ ভয়ের কারণ বলে জানান তারা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যাদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেরই শহরে বাড়ি রয়েছে। আবার অনেকেই শহরে ছোটখাটো কাজ করেন। দূরত্বের কারণে বেশিরভাগই এই আশ্রয়ণের ঘরে থাকেন না। যশোর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৫টি পর্যায়ে যশোর জেলায় মোট ২ হাজার ৫০৬টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পূর্বের ব্যারাকের ঘর (জরাজীর্ণ টিনের শেড) সংস্কার করে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে ৩০৩টি।
জানতে চাইলে যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভূমিহীন মানুষের জন্য সরকার ২ শতক করে জমির ওপরে ঘর করে দিয়েছে। যাদের নামে বরাদ্দ, তারা থাকেন। অনেকেই ভাসমান মানুষ। তারা দিনের বেলা শহরে কাজ করেন, রাতে তারা ওই ঘরে থাকেন বলে জেনেছি। যদি বরাদ্দ পাওয়া ঘরে কেউ না থাকে এমন তথ্য থাকলে আমরা সংশ্লিষ্ট কমিটিকে জানাব। তারা উপযুক্ত ব্যক্তিকে সেখানে বন্দোবস্ত করে দেবে।