মোঃ ইব্রাহীম মিঞা, দিনাজপুর প্রতিনিধি
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার পলিপ্রয়াগপুর ইউনিয়নের পলিপ্রয়াগপুর দাখিল মাদ্রাসা মাঠে শুক্রবার বিকেল থেকে অনুষ্ঠিত হলো গ্রামবাংলার হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা ‘পাতা খেলা’।
মাঠজুড়ে ছিল মানুষের ঢল। চারদিক থেকে নারী-পুরুষ, শিশু ও প্রবীণরা ভিড় জমায় খেলার অনন্য দৃশ্য দেখতে। মহাসড়কের পাশে হওয়ায় অনেকে পথিমধ্যে যানবাহন থামিয়ে খেলাটি উপভোগ করেন। মাঠের পাশে বসে যায় নানা দোকান ঝালমুড়ি, চটপটি, ফুচকা,চা, পাঁপড়, খেলনা সামগ্রী ও বেলুনের দোকান। চারদিক আলো আর উল্লাসে ভরে ওঠে যেন ছোট্ট এক গ্রামীণ মেলা।
এবারের খেলায় অংশ নেন ৬ জন গণক এবং ৩ জন পাতা (তুলা রাশির ব্যক্তি)। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে শুরু হয় খেলা, যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। খেলায় গণকেরা নির্দিষ্ট পাতাদের দিকে মন্ত্রপাঠ করে পাতা নিক্ষেপ করেন। যার দিকে সবচেয়ে বেশি পাতা গিয়ে পড়ে, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
বিজয়ী গণককে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় একটি খাশি ছাগল, আর রানার্স আপ পান এক জোড়া রাজহাঁস। অংশগ্রহণ ফি হিসেবে প্রতিটি গণককে দিতে হয় ১,০০০ টাকা।
খেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল গণকদের নৃত্য ও আচার অনুষ্ঠান। তারা কারও হাতে মানুষের মাথার খুলি, কারও হাতে হাড়-হাড্ডি, সিঁদুর, চাকু, কলাগাছের কাণ্ড, বিভিন্ন পাত্র ও জ্বলন্ত মশাল সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক রহস্যময় দৃশ্য। গান, ঢোল আর শঙ্খের আওয়াজের সঙ্গে মন্ত্র ও তন্ত্রের পাশাপাশি তারা নৃত্য করে পাতাদের দিকে আকর্ষণ সৃষ্টি করেন।
এবারের খেলায় বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে ফজিলা নামে নারী গণকের অংশগ্রহণ তিনি নিজের ভাইয়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে খেলায় অংশ নেন। দর্শকদের জন্য এটি ছিল ব্যতিক্রম ও আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা।
খেলা শেষে গণক মোখলেছার রহমান বলেন, এই খেলায় বিশ্বাস, মন্ত্র আর কৌশলের মিশেল আছে। আমরা ছোটবেলায় এই খেলা দেখে মুগ্ধ হতাম, আজ আবার খেলতে পারছি এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ।
নারী গণক ফজিলা বলেন, মেয়েরা আগে এসব খেলায় অংশ নিত না। এবার সাহস করে এলাম। ভাইয়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে খেলতে পেরে ভালো লাগছে।
পাতা হিসেবে অংশ নেওয়া রফিকুল (ছদ্মনাম) বলেন, খেলার সময় শরীর ভারী লাগে, ঘোরের মধ্যে থাকি। খেলা শেষে প্রচণ্ড ব্যথা হয় শরীরে, কিন্তু এই ঐতিহ্যের অংশ হতে পারাটাই বড় পাওয়া।
আরেকজন পাতা নিতুন্জু বলেন, এটা খেলা হলেও মনে হয় যেন এক অজানা শক্তির লড়াই। ব্যথা ভুলে যাই, যখন দেখি গ্রামের সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে।খেলা শেষে প্রতিটি পাতাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা সম্মানী প্রদান করা হয়।
দর্শক বেলাল হোসেন খৈয়ম বলেন, এমন খেলা এখন খুব কম দেখা যায়। মানুষ আনন্দ পাচ্ছে, আবার গ্রামের পুরনো ঐতিহ্যও ফিরে আসছে।
গ্রামবাসী বলেন, শিশুদের জন্যও এটা শিক্ষণীয়। তারা জানছে আমাদের গ্রামের সংস্কৃতি কেমন ছিল।নৌবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত এক সদস্য বলেন, পাতা খেলা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আগে প্রায়ই মাঠে এমন খেলা হতো, এখন হারিয়ে গেছে। আজকের আয়োজন প্রমাণ করল আমাদের তরুণরা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
সূর্য ডোবার পরও মাঠে মানুষের ভিড় ছিল অটুট। কেউ ঢোল বাজাচ্ছে, কেউ আলো জ্বালাচ্ছে, কেউ গল্প করছে পুরনো দিনের খেলার কথা।এই ‘পাতা খেলা’ যেন আবার মনে করিয়ে দিল গ্রামীণ জীবনের আনন্দ, রহস্য আর ঐতিহ্যের টান আজও ফুরিয়ে যায়নি।