মো: শিহাব হোসেন, বুটেক্স প্রতিনিধি
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কচুরিপানা ও পুনর্ব্যবহৃত ডেনিম ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব জুতা তৈরি করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। তাদের উদ্ভাবিত প্রকল্পের নাম ‘ইকো স্টেপ’, যা সম্প্রতি ‘রাউন্ডটেবিল গ্লোবাল ইউথ অ্যাওয়ার্ডস–২০২৫-এ ফাইনালিস্ট হিসেবে মনোনীত হয়েছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে কচুরিপানা একটি বহুল পরিচিত সমস্যা, যা পরিবেশের জন্য উপদ্রব হিসেবেই বিবেচিত হয়। অন্যদিকে ডেনিম—বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত পোশাক যা উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয় এবং ব্যবহারের পর এসব ডেনিম ফেলে দেওয়া হয়, যা পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই দুই সমস্যা সমাধানের প্রয়াসে বুটেক্সের চার শিক্ষার্থী অন্বয় দেবনাথ, অর্ণব হালদার, ফারদীন বিন মনির ও তাশফিক হোসাইন পরীক্ষামূলকভাবে কচুরিপানা ও ফেলে দেওয়া ডেনিম কাপড় দিয়ে জুতা তৈরি করেন।
প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মারজিয়া দুলাল। শিক্ষার্থীরা কচুরিপানা দিয়ে জুতার ইনসোল (ভেতরের সোল) ও আউটার সোল তৈরি করেছেন এবং পুনর্ব্যবহৃত ডেনিম দিয়ে জুতার বাইরের আবরণ তৈরি করেছেন।
‘রাউন্ডটেবিল গ্লোবাল ইউথ অ্যাওয়ার্ডস–২০২৫-এর এবারের আসরে ৯০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় ৪০০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন। সেখান থেকে ‘ইকো স্টেপ’ এনভায়রনমেন্ট ইনোভেশন ক্যাটাগরিতে সেরা তিনের মধ্যে স্থান পেয়েছে। আগামী ৮ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে কিংস্টন ভেন্যুতে ফাইনাল পর্ব অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।
মনোনয়নের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাশফিক হোসাইন বলেন, “গ্লোবাল ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডের এটি ১৩তম আসর। আমরা সেপ্টেম্বরের শুরুতে আমাদের আবেদন জমা দিই। আবেদন জমা দেওয়ার সময় প্রজেক্টের বিস্তারিত, কেন আমরা পুরস্কারটির যোগ্য, এবং আমাদের দাবির প্রমাণস্বরূপ ছবি, সংবাদ প্রতিবেদন ও অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়।”
তবে সময় স্বল্পতা ও খরচের কারণে শিক্ষার্থীরা লন্ডনে সরাসরি যেতে পারছেন না; তারা অনলাইনে অনুষ্ঠানে যুক্ত হবেন। অর্ণব হালদার বলেন, “ফাইনালে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি গতকাল (২১ নভেম্বর) আমাদের ইমেইলে জানানো হয়। অফলাইনে যেতে না পারলেও অনলাইনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে। সময় কম থাকায় ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা কঠিন, আর যাতায়াত খরচও অনেক বেশি। তাই আমরা অনলাইনে অংশ নেব।”
ফাইনালে উঠতে পেরে অন্বয় দেবনাথ বলেন, “এত বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কারের ফাইনালে উঠব, সেটা কল্পনাতেও ছিল না। বুটেক্স থেকে আন্তর্জাতিক মানের উদ্ভাবন উপস্থাপন করতে পারা আমাদের জন্য গর্বের।”
ফারদীন বিন মনির বলেন, “ফাইনালিস্ট হতে পেরে আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো লাগছে। আমরা চাই এই প্রজেক্টটিকে ভবিষ্যতে আরও গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিতে।”
প্রকল্পটির তত্ত্বাবধায়ক ড. মারজিয়া দুলাল বলেন, “এই সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব শিক্ষার্থীদের। আমি শুধু দিকনির্দেশনা দিয়েছি। ফাইনালে ওঠাটাই বুটেক্সের জন্য বড় অর্জন, বিশেষ করে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের জন্য। এটি প্রমাণ করে, আমাদের শিক্ষার্থীরা দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বমানে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।”
বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাসুম শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “বৃত্তাকার অর্থনীতির যুগে টেক্সটাইল বর্জ্য থেকে জুতা তৈরি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। পরীক্ষাগারের সীমিত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা টেকসই উদ্ভাবন উপহার দিয়েছে। আমি চাই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করে এমন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করুক।”
উল্লেখ্য, রাউন্ডটেবিল গ্লোবাল ও লেগ্যাসি প্রজেক্ট গ্লোবাল যৌথভাবে এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি আয়োজন করে। ১১ থেকে ২৫ বছর বয়সী সেই সব তরুণদের সম্মান জানানোই এ অ্যাওয়ার্ডের লক্ষ্য, যারা বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এবারের আয়োজনের মূল থিম হলো “Environmental Regeneration” এবং মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ১৪ সেপ্টেম্বর।