হুমায়ন কবির মিরাজ, বেনাপোল
“পুরো বাংলাদেশটাই দুর্নীতিগ্রস্ত—লিখেন! যত পারেন লেখেন! দেশের সব পত্রিকায় লেখা হয়েছে, তাতে কী হয়েছে?”সাংবাদিক পরিচয় জানতেই এভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন যশোরের শার্শা উপজেলা প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ হক।
রোববার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে শার্শা উপজেলার বহুল আলোচিত সাতমাইল–গোগা ১০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাষায় কথা বলেন।
প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ হক বলেন,“যারা কাজের মান খারাপ হওয়ায় রাস্তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল, তারাই আবার টাকা খেয়ে কাজ চালু করেছে। আমি দশ দিন পরে রিপোর্ট দেব—সব ঠিক আছে। কোথাও কোনো গরমিল নেই।”
নিম্নমানের পাথর, ময়লাযুক্ত খোয়া, পুরনো সামগ্রী, রড ও সিমেন্টের পরিমাণ কম ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্টভাবে জানান, এসব বিষয় আমলে নেওয়া হবে না।
একপর্যায়ে তিনি বলেন,“এই বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার মতো রুচি আমার নেই। যা লেখার লিখেছেন, আরও লেখেন।”
এ সময় কথোপকথনের মধ্যেই এলজিইডির আরেক কর্মকর্তা প্রকৌশলীর কক্ষে প্রবেশ করে জানতে চান—এই সড়ক নির্মাণ নিয়ে কোন সাংবাদিক তার কাছে ফোন করেছেন। ওই সাংবাদিকের নম্বর চাইতে গিয়ে তিনি বলেন,“ঠিকাদারের লোক এসেছে—এদের দিয়ে শাসিয়ে দিচ্ছি।”
প্রকৌশলীর কক্ষে চা পরিবেশন করা হলেও এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে তা গ্রহণ না করেই উপস্থিত স্থানীয় সাংবাদিকরা কক্ষ ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে শার্শা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও বাগআঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক শাহারিয়ার মাহমুদ রঞ্জু বলেন,“স্থানীয়দের পক্ষ থেকে কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। একদিন কাজ বন্ধ ছিল। কিন্তু শুক্র ও শনিবার সরকারি বন্ধের দিনে কীভাবে আবার অভিযুক্ত সড়কে সিসি ঢালাই শুরু হলো—তা আমার জানা নেই।”
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের উন্নয়নকাজে প্রকৌশলীর দপ্তরের আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে সাতমাইল–গোগা সড়কের বসতপুর বাজার এলাকায় প্রায় ৩৫০ মিটার সিসি ঢালাইয়ের কাজ চলছিল। ঢালাইয়ের কয়েকদিন পরই পায়ের আঙুল দিয়ে সামান্য চাপ দিলেই উঠে আসছিল সিমেন্ট–বালির সঙ্গে মেশানো খোয়া। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকাবাসী ও প্রশাসনিক দপ্তরের হস্তক্ষেপে কাজ বন্ধ করা হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না যেতেই পুনরায় সিসি ঢালাই শুরু হওয়ায় জনমনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন উপজেলা প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ হক।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,“নড়াইলের ‘ইডেন এন্টারপ্রাইজ’ নামে কাজটি দেওয়া হলেও বাস্তবে যশোরের সাঈদ নামের এক ঠিকাদার কাজটি করছে। তার হাত অনেক লম্বা।”
শার্শা উপজেলা এলজিইডি অফিস সূত্র জানায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রকল্প উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচির আওতায় বাগআঁচড়া ইউনিয়নের সাতমাইল থেকে গোগা বাজার পর্যন্ত ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বাজার এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার সিসি ঢালাইয়ের কাজ অন্তর্ভুক্ত।
ইতোমধ্যে সেতাই বাজারের কিছু অংশের কাজ শেষ হলেও বসতপুর স্কুল মোড় থেকে বাজারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ মিটার সিসি ঢালাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। তবে কাজের শুরু থেকেই নির্ধারিত নকশা ও মানদণ্ড অনুসরণ না করে নিম্নমানের রড, ইট ও পাথরের খোয়া ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত অনুপাতে সিমেন্ট ব্যবহার না করায় ঢালাইয়ের গুণগত মান নিয়ে চরম শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, উপজেলা প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ হকের প্রত্যক্ষ যোগসাজশেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমন নিম্নমানের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঢালাইয়ের স্থানে সামান্য চাপ দিলেই উঠে আসছে ইটের খোয়া—যা পুরো প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

