মুক্ত কলামঃ মেহেদী হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হতে বেড়ে উঠেছি। ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়া হতে শুরু করে বেড়াতে যাওয়ার বাহন ছিল রিক্সা যা পা দিয়ে পরিশ্রম করে চালাতে হতো। অনেক বয়স্ক লোক যখন কষ্ট করে আমাকে চালিয়ে নিয়ে যেতো তখন এক প্রকার অপরাধবোধ কাজ করতো। উচু যায়গায় উঠতে সে যখন নেমে আমাকে টেনে নিয়ে যেতো আমি ও তখন রিক্সা হতে নেমে হাটতাম। উঁচু জায়গা হতে নামার পর আবার রিকশায় উঠতাম।পথে ঘাটে মালবহনকারী কত রিকশা ভ্যানকে আমি ঠেলে উপরে উঠতে সাহায্য করেছি, তার হিসাব নেই। তাদের পরিশ্রম দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগতো। তাদের মুখে কেন যেন আমি আমার বাবার চেহারা দেখতে পেতাম।এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর একদিন এই পরিশ্রম , কষ্ট লাঘব হবে এমনটা প্রায়ই প্রার্থনা করতাম।
এখন আসি মূল কথায়। ব্যাটারি চালিত রিকশা চালু হওয়ায় এই শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের কিছুটা লাঘব হয়েছে। এতে আমার ব্যক্তিগত কোন সমস্যা নেই। বরঞ্চ খেটে খাওয়া শোষিত এই মানুষগুলো একটু আরামে রিকশা অথবা ভ্যান চালাচ্ছে এটা দেখে আমার ভালো লাগে। আমি শিশুকাল থেকেই শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে। তাদের ঘাম আমাকে ব্যথিত করে। রাষ্ট্রে যখন ব্যাটারি চালিত রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠেছে এই প্রশ্নে আমি ব্যাটারি চালিত রিকশাচালকদের পক্ষে আমার পরিষ্কার অবস্থান। পরিবেশ এর দোহাই দিয়ে ব্যাটারী চালিত রিকশা বন্ধ করা অনুচিত। রাষ্ট্রের উঁচু তলার মানুষ গুলো যেভাবে এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করছে তাতে পরিবেশ আরো বেশি দূষিত হচ্ছে। উপদেষ্টাগন যদি মনে করেন রাষ্ট্রে অনেক সংস্কার প্রয়োজন তাহলে অনেক সেক্টরে ই সংস্কার করতে পারেন। এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করে রাষ্ট্রের ক্ষতি ই হবে। এটার আগে ব্যাক্তিগত গাড়ী বন্ধ করা উচিত। সবাইকে পাবলিক বাসে চড়ার বিধান করলে রাষ্ট্র উপকৃত হবে। আর এই আধুনিক যুগে মানুষ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের খেটে খাওয়া মানুষগুলো কেন আবার পেছনে যাবে এটা আমার বোধগম্য নয়।
প্রধান উপদেষ্টা দেশকে আমেরিকা বানিয়ে দেবেন এমন স্বপ্ন অনেকেই দেখেছে কিন্তু বাংলাদেশ কে রাতারাতি উন্নতির এমন চরম শিখরে পৌঁছে দিতে হলে সবাইকে তার সুপারসনিক বিমানে আরোহণ করতে হবে। তাতে এই সুপারসনিক বিমানে আরোহণ করা এই সামান্য খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে হয়তো মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব হবে।
প্রিয় রাষ্ট্র যন্ত্র, আপনার সুমতি হোক, আপনি জনগণের জন্য কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবেন এমনটাই সবার প্রত্যাশা। এই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষগুলো ব্যাটারি ব্যবহার করে রিক্সা চালায় তাতে রাষ্ট্র তোমার কি এমন ক্ষতি? এই মেহনতি মানুষগুলো যা করছে তা পেটের কারনে। রাত পোহালেই সংসারে ঘানি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এমনিতেই অসুরের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। অনেকেরই এই ব্যাটারি চালিত রিকশাটি কেনা হয়েছে কিস্তির মাধ্যমে ঋণ করে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে হলে তাকে এই রিকশাটি চালাতে হবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি না হয় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে জানেন না, কাঁচা কিন্তু সুদ ঋণ কিস্তি এসব তো বোঝেন। এ বিষয়ে তো আপনার ভুল হবার কথা নয়। আপনার তো জানা উচিত কথিত জুলাই আগষ্ট লাল বিপ্লবে এরাও আপনার অংশীদার। তারাও দেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছে। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়াই কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কাজ।
মালিবাগের ষাটোর্ধ্ব রিক্সাওয়ালা আবুল মিয়া যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে তার প্রাণের আকুতি, ব্যাটারি চালিত রিকশাটি যেন বন্ধ না হয়। ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে যেন তাকে পথে না নামতে হয়। আমার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের কোনের এক বিন্দু অশ্রু মুছতে মুছতে বললেন -- কি এমন ক্ষতি রাষ্ট্র তোমার , যদি আমি ঘামে না ভিজি। আবুল মিয়ার রিক্সা ততক্ষণে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল পথের শেষ সীমানায়। তার শেষ কথাগুলো আমার কানের কাছে বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে -- কি এমন ক্ষতি রাষ্ট্র তোমার? যদি আমি ঘামে না ভিজি।
ম,হাসান
২৩ নভেম্বর ২০২৪
গোপালগঞ্জ
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.