সাইফুল ইসলাম, বাবুগঞ্জ (বরিশাল)
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর (জাহাঙ্গীরনগর) ইউনিয়নে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পেরিয়েও দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এটি এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে, যা বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারি সহযোগিতা ও প্রচারের অভাবে জাদুঘরটি তার পূর্ণতা পায়নি। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জাদুঘরের বাইরের অংশ জঙ্গলে ঢাকা এবং ভেতরের অবস্থাও তথৈবচ। গত তিন বছর ধরে কোনো কেয়ারটেকার নেই, যার ফলে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে পুরো স্থাপনা। গ্রন্থাগারের শেল্ফগুলো ভাঙাচোরা ও খালি পড়ে আছে, নেই পর্যাপ্ত বই। সাহিত্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান বা রচনাবলী সংক্রান্ত কোনো বই চোখে পড়ে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বীরত্বগাঁথা ও জীবনী সংক্রান্ত কোনো বইও এই জাদুঘরে পাওয়া যায়নি। কক্ষের দরজা ভাঙা এবং ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে, যা ভেতরের পরিবেশকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে।
বীরশ্রেষ্ঠের আত্মীয় ও একই গ্রামের বাসিন্দা মো. হারুন অর রশিদ জানান, তিনি দুই বছর অস্থায়ীভাবে বিনা পারিশ্রমিকে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর একজন লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ পেলেও তিনি প্রায় দুই-তিন বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে আরও একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ পেলেও তিনিও কিছু দিন পর কাজ ছেড়ে দেন। কেউ-ই বিনা বেতনে কাজ করতে রাজি হননি। ২০২২ সালে কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির দুটি পদই শূন্য। কেয়ারটেকারের ছেলে চাকরির আশায় কিছু দিন অস্থায়ীভাবে কাজ করলেও আশ্বাস না পেয়ে তিনিও দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বর্তমানে দীর্ঘ দিন ধরে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে, এমনকি কোনো দর্শনার্থীও ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেন না।
বীরশ্রেষ্ঠের একমাত্র জীবিত ছোট ভাই মনজুর রহমান বাচ্চু আক্ষেপ করে বলেন, তার সাহসী ভাই নিজ জন্মভূমিতে যতটা সম্মানের সঙ্গে আছেন, ঠিক ততটাই অবহেলার শিকার। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবি, ভিডিও আর্কাইভ থাকলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ইতিহাস জানার সুযোগ পেত।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বেইজ কমান্ডার বীর প্রতীক রতন শরীফ এই ঘটনাকে 'কষ্টদায়ক' উল্লেখ করে বলেন, "যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি, তাদের স্মৃতি ও ইতিহাসকে আমরা পদদলিত করে চলেছি।" তিনি বীরশ্রেষ্ঠদের স্মৃতির প্রতি এমন অযত্ন-অবহেলা থেকে বেরিয়ে আসার এবং তাদের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
২০০৮ সালে বরিশাল জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরের এমন বেহাল দশা সত্যিই হতাশাজনক। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সম্প্রতি জাদুঘরটি পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, শুধু বাবুগঞ্জ নয়, সারা বাংলাদেশে এরকম ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের জানার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ আমানুল্লাহ খান নোমান বলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানের নামে একটি জাদুঘর থাকলেও স্বাধীনতার এত বছরেও জেলার কোথাও কোনো পথনির্দেশক নেই। তিনি মনে করেন, বর্তমান প্রজন্ম ভালোভাবে জানে না যে বরিশালের বাবুগঞ্জে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মতো একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান রয়েছেন। তাই তিনি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বিএসএস-১০৪৩৯) ১৯৬৯ সালের ৭ই মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর (বর্তমান জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন) ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ০৩ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বন্দিত্ব ছিন্ন করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় ৭নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তিনি শাহাদাতবরণ করেন এবং ১৫ই ডিসেম্বর তার মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতির প্রতি এমন অবহেলা বন্ধ করে দ্রুত এই জাদুঘর ও গ্রন্থাগারকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয় জনগণ ও সুশীল সমাজ।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.