মো: সাদ্দাম হোসেন, সিলেট প্রতিনিধি
ধলাই নদীর বুকজুড়ে ছিল সাদা পাথরের স্তর। পাথরের গায়ে পানির ছোঁয়া, ওপারে সারি সারি পাহাড়—এই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় করতেন সিলেটের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে।
কিন্তু সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন অতীত। গেল বছরের ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া পাথর লুটের পর এক বছরে পুরো এলাকা যেন হয়ে গেছে এক ধ্বংসস্তূপ। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পেছনে বয়ে চলা ধলাই নদীর জলে এখন আর চিকচিক করে না সাদা পাথর।
এই এক বছরে শত কোটি টাকার পাথর লুট হলেও প্রশাসন নীরব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশেষে লুটপাট শেষ হওয়ার পর করণীয় ঠিক করতে বুধবার (আজ) একটি সভা ডেকেছে জেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, এই পাথর লুটের পেছনে রাজনৈতিক মদদও ছিল। ইতোমধ্যে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থিত সাদাপাথর, যা ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। আদালত ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে কয়েক বছর ধরে সেখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল।
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। সেই সুযোগে কয়েকশ’ কোটি টাকার পাথর লুট হয় সাদাপাথর এলাকা থেকে। অভিযোগ ওঠে, এতে স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতার সরাসরি মদদ ছিল।
পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ ও সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর কিছুদিনের জন্য পাথর লুট বন্ধ হয়। এরপর পরিবেশ এবং খনিজসম্পদ উপদেষ্টা সিলেট সফরে এসে সব পর্যটন এলাকা থেকে অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
কিছুদিন অভিযান চালালেও পরে আবারও পাথরখেকোরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পুরো সাদাপাথর এলাকা থেকে সব পাথর লুটে নেয়া হয়।
বর্তমানে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধলাই নদীর বুকজুড়ে আর কোনো পাথর নেই। নদীর তলদেশের পাথর তো বটেই, মাটির নিচ থেকেও গর্ত করে তুলে নেওয়া হয়েছে সব পাথর। ফলে সাদাপাথর এখন কঙ্কালসার এক বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে।
লুটপাটের বিষয়টি দেশব্যাপী আলোচনায় এলে প্রশাসনের টনক নড়ে। গতকাল বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় সাদাপাথর এলাকায়। তবে আগের রাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর সেদিন এলাকাটি বেশ ফাঁকা দেখা গেছে।
এদিকে, পরিবেশবাদীরা অভিযোগ তুলেছেন, এই পাথর লুটের পেছনে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের মদদ রয়েছে। পরিবহন ধর্মঘট, প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক এবং কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে মিছিল-সমাবেশে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের অংশগ্রহণ সেই অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’-এর সিলেট শাখার সদস্য সচিব আব্দুল করিম কিম বলেন,
“পাথর লুটপাট বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সিলেটের প্রকৃতিবিনাশের দায় নিতে হবে এই অথর্ব প্রশাসনকে। প্রশাসনের এই ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে, শত কোটি টাকার লুট থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ।”
অন্যদিকে, সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন,
“সাদাপাথর রক্ষায় প্রশাসনের কোনো গাফিলতি ছিল না। লুটপাট বন্ধ ও করণীয় ঠিক করতে আজ (বুধবার) সভা ডাকা হয়েছে। এই সভা থেকেই ঠিক হবে, প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল এবং ভবিষ্যতে কী করা উচিত।