রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনা নগরীতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অক্টোবরের প্রথম নয় দিনেই নগরীতে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িতদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা তানভীর হাসান শুভ ছিলেন নিজের ঘরে মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। গত ১ অক্টোবর রাতে ঘরের জানালা দিয়ে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাতেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন তাঁর বাবা। আট দিন পার হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এই ঘটনার রেশ না কাটতেই গত ৬ অক্টোবর রাতে নগরীর কাস্টমঘাট এলাকায় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় তরুণ ইমরান মুন্সিকে। চার দিনেও এ মামলার কোনো অগ্রগতি নেই।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় নগরীর সঙ্গীতা সিনেমা হলের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সাবেক নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন জনযুদ্ধের সদস্য শাহাদাত হোসেনকে। প্রায় ২২ বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন তিনি। হতাশ পরিবার মামলা করতে রাজি হয়নি, পরে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। সেই মামলায়ও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
সবশেষ গতবৃহস্পতিবার সকালে খালিশপুর হাউজিং বাজার এলাকায় সবুজ খান (৫৫) নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষরা। খালিশপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী জানান, পূর্বশত্রুতার জেরে প্রতিবেশীরা তাঁকে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয়রা আহত অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনায় জড়িত এক নারীকে আটক করা হয়েছে।
তিন মাসের ব্যবধানে শুধু মহেশ্বরপাশা এলাকায় তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে—যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা, ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদার এবং তানভীর হাসান শুভ। দৌলতপুর থানায় তিনটি পৃথক মামলা হলেও অধিকাংশ আসামি এখনো ধরা পড়েনি। মাহবুব হত্যায় চারজনকে আটক করা হলেও দুই মাস ধরে মামলায় অগ্রগতি নেই, উদ্ধার হয়নি হত্যার অস্ত্রও।
তানভীর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বদিউর রহমান বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, খুব দ্রুত ভালো খবর দিতে পারব।” একই বক্তব্য দেন আলামিন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।
নিহত মাহবুবের বাবা আবদুল করিম মোল্লা বলেন, “খুনিদের সবাই চেনে, অথচ তিন মাসেও ধরা পড়ল না কেউ। তাদের গ্রেপ্তার হলে শুভ হয়তো বেঁচে যেত।” আলামিনের বড় ভাই আওলাদ শেখ বলেন, “দুই মাস হয়ে গেল, কেউ ধরা পড়েনি। বিচার চাইতেও ভয় লাগে এখন।”
দৌলতপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, “তিনটি মামলা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।”
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অপরাধ শাখার তথ্য অনুযায়ী, গণঅভ্যুত্থানের পর গত ১৪ মাসে খুলনায় ৩৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩টি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। এসব ঘটনায় জড়িত অধিকাংশই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য। কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, “এ পর্যন্ত ৯ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৫২ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানুষ আগের মতো পুলিশকে তথ্য দিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। জনগণ সহযোগিতা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি কুদরত-ই-খুদা বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল, যা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। থানা ও ফাঁড়ি পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তা আগের মতো সক্রিয় নন। এতে সন্ত্রাসীরা সুযোগ নিচ্ছে, ফলে হত্যা ও অপরাধ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক সরকার আসার আগ পর্যন্ত অনেক কর্মকর্তা গা বাঁচিয়ে চলছেন। সমাজেও অস্থিরতা বেড়েছে, মানুষ সহজেই মারমুখী হয়ে উঠছে।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বড় রাজনৈতিক অস্থিরতার পর তরুণ সমাজে হতাশা ও অস্থিরতা বেড়েছে। তুচ্ছ বিষয়েও মারামারি ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। খুলনার সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর আসামিদের বড় অংশ তরুণ।”
হত্যা মামলার তদন্তে যুক্ত পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, অভ্যুত্থানের আগে সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকত। অভ্যুত্থানের পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারা আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার ওসি (তদন্ত) মিজানুর রহমান বলেন, “শাহাদাতকে হত্যা করেছে বি কোম্পানির সন্ত্রাসীরা। তারা তাঁর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।”
কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, “অভ্যুত্থানের পর পুলিশের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছে। সেই সুযোগে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নেমেছে। কিছু গ্রুপ প্রধানকে গ্রেপ্তার করার পর ফাঁকা মাঠে অন্যরা দখল নিতে চায়, ফলে নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি শুরু হয়েছে।”
নগরীতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক বাড়ছে। খুলনার নাগরিকরা বলছেন, হত্যা বন্ধ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, প্রশাসন ও জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ এখন সবচেয়ে জরুরি।