রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনার জেলখানা ফেরিঘাট—দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যস্ত ঘাট। প্রতিদিন শত শত ট্রাক, বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, ইজিবাইক, ভ্যান ও মোটরসাইকেল এ ঘাট দিয়ে পারাপার হয়। অথচ এই ব্যস্ত ফেরিঘাটে প্রতিদিন যে পরিমাণ টোল আদায় হচ্ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি সরকারি কোষাগারে জমা পড়ছে না। অভিযোগ উঠেছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কার্যসহকারী মো. আব্দুল ওয়াদুদ ও তার সহযোগীরা কর্মকর্তাদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়মিত টোল আত্মসাৎ করছেন।
গত ৩০ বছর ধরে সওজ বিভাগ ইজারাদারের মাধ্যমে টোল আদায় করে আসছিল। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে জটিলতা ও মামলার কারণে চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে বিভাগটি নিজেই টোল আদায় শুরু করে। এরপর থেকেই শুরু হয় লুটপাটের মহোৎসব।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফেরিঘাটে প্রতিদিন গড়ে ১৫–২০টি ইজিবাইক ও ভ্যান পারাপার হচ্ছে, পাশাপাশি একাধিক ট্রাক ও বাস ঘাট ব্যবহার করছে। কিন্তু রেজিস্টারে সেসবের অল্প কিছু নামমাত্র তথ্য লেখা হচ্ছে। টোল আদায় করা হলেও কাউকে রশিদ দেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে কার্যসহকারী মো. আব্দুল ওয়াদুদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমাদের প্রতিদিন ভিআইপি যাত্রী পার করাতে হয়, অনেকে টাকা না দিয়েই চলে যান। অনেকে রশিদ নিতে চান না, তাই দেওয়া হয় না।”
তবে ঘাটের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে পাওয়া যায় বড় অসঙ্গতি। সওজ জানায়, প্রতি সপ্তাহে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়া হচ্ছে। অথচ ফেরির ডিজেল খরচেই সপ্তাহে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। প্রতিদিন কর্মচারীদের খোরাকি বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার টাকা।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী গোপাল কুমার সাহা বলেন, “সপ্তাহে প্রায় ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়া হচ্ছে।” তবে জমাকৃত অর্থের কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জাহিদুর রহমান স্বীকার করেন, “নিয়ম অনুযায়ী রশিদ দিয়ে টোল নেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।”
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তানিমুল হক বলেন, “হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। ফলে ঘাটটি সওজ নিজেরাই পরিচালনা করছে। তবে এতে বছরে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “অভ্যন্তরীণ তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে আদায়ের টাকা জমা হচ্ছে না, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঘাট সংক্রান্ত একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় ১৫ বছর ধরে সওজের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আশীর্বাদে ‘ধ্রুব এন্টারপ্রাইজ’ নামমাত্র মূল্যে ঘাটটির ইজারা নিয়ে আসছে। সর্বশেষ দরপত্রে নতুন দরদাতা ‘জহুরুন অ্যান্ড সন্স’ ৯৬ লাখ ১০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দর দিলেও মামলা করে ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও হাইকোর্টে নতুন করে আদেশ আসায় প্রক্রিয়া আবারও থেমে যায়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, আদালতের এই মামলাজট আর প্রশাসনের উদাসীনতার সুযোগে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল অসাধু কর্মচারী। টোলের টাকা কাগজে-কলমে হারিয়ে যাচ্ছে, আর সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।