খুলনা প্রতিনিধি
সুন্দরবন ঘেঁষা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী খুলনার কয়রার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে নোনাপানির সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা ও জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। কৃষি, মাছচাষ এবং সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ—সবই ব্যাহত হচ্ছে।
দক্ষিণ বেদকাশির ছোট আংটিহারা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আবু মুসা গাজী বলেন, “চারিদিকে অথৈ পানি থাকলেও তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।” স্থানীয় শিশুদেরও একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আশরাফ হোসেন, মোনায়েম, নাঈম ইসলাম ও বুলবুল আহম্মেদ জানায়, নদীতে ঝাঁপানো বা খেলাধুলা করলে শরীরে জ্বালা লাগে। “এখানে নদী, খাল ও পুকুরের সব পানি লোনা। বাধ্য হয়ে লোনা পানিতেই নামতে হয়,” তারা যোগ করেন।
কয়রার মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস হলো সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ ও মাছচাষ। তবে অতিবৃষ্টি, নদী ও মাটিতে লবণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে মাছচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় রেজাউল গাজী, আমজেদ শেখ এবং আলামিন ইসলাম বলেন, “কয়রার মানুষ কেবল লবণাক্ত পানির সঙ্গে বসবাস করছে না, তারা প্রতিদিন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে লড়ছে। এই লড়াইয়ে প্রয়োজন নিরাপদ পানির টেকসই ব্যবস্থা, নারীর স্বাস্থ্যসেবা এবং জলবায়ু অভিযোজনের পরিকল্পনা।”
দক্ষিণ বেদকাশির আব্দুর রব বলেন, “খরা, ঝড়, বৃষ্টি ও নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আইলার পর পুরো এলাকা উদ্ভিদশূন্য হয়ে গেছে। লবণাক্ততার কারণে সব গাছ মারা গেছে। সব সময় সুপেয় পানির অভাবে থাকতে হয়।”
উপকূলীয় এলাকায় এক লাখেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, উপকূলে প্রতি লিটার পানিতে লবণের মাত্রা ১,০০০–১০,০০০ মিলিগ্রাম, যা মানবদেহের জন্য নিরাপদ নয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কয়রায় ২৫ শতাংশ মানুষ পানির সংকটে থাকলেও বাস্তবে চিত্র অনেক ভয়াবহ।
জলবায়ু সচেতনতা এবং সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা এবং পানির সংকট মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।”
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম বলেন, “উপকূলীয় শিশুদের নানা রোগ এবং নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে। অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ু সংক্রমণ ও ক্যান্সারের মতো রোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ লবণাক্ত পানি।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল বাকি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। তবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং সচেতনতার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে উপকূলকে দুর্যোগসহিষ্ণু করা সম্ভব।”
কয়রার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম প্রমাণ করছে, নোনাপানি ও লবণাক্ত মাটির সঙ্গে লড়াই শুধুই দৈনন্দিন সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ। সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং টেকসই জলবায়ু অভিযোজন ছাড়া এই সংগ্রামের স্থায়ী সমাধান কঠিন।

