মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
চা-বাগানের সবুজ সমারোহ, হাওরের নীল জলরাশি আর পাহাড়ি ঝর্ণার অপার সৌন্দর্য—সব মিলিয়ে পর্যটনের বিশাল ভাণ্ডার জুড়ী উপজেলা। মৌলভীবাজারের এই জনপদে রয়েছে প্রকৃতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনন্য সমন্বয়। তবুও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে পিছিয়ে পড়েছে এখানকার পর্যটন শিল্প।
জুড়ীর পর্যটন সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় রত্ন হাকালুকি হাওর। বর্ষায় নৌভ্রমণের রোমাঞ্চ আর শীতে পরিযায়ী পাখির কোলাহল এই হাওরকে পরিণত করে অনন্য আকর্ষণে। পাশাপাশি পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টে রয়েছে সীতাকুণ্ড, মায়াবন, মায়াকানন, সন্ধানী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বিষকরমসহ অসংখ্য ঝর্ণা।
এছাড়া হাতিনালা গিরিখাত, ব্রিটিশ আমলের লাঠিটিলার ঐতিহাসিক আয়রন ব্রিজ, ধসেল পাহাড়ের শিবমন্দির, কাশ্মির টিলা, লালছড়া-হায়াছড়া কমলা বাগান, সাগরনালের হাড়ারগজ সংরক্ষিত বন এবং সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ চূড়া কালাপাহাড়—সব মিলিয়েই জুড়ীকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। খাসিয়া ও মনিপুরি জনগোষ্ঠীর জীবনধারা ও সংস্কৃতি বাড়িয়েছে এর আকর্ষণ।
কিন্তু সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, পর্যটকবান্ধব সুবিধার অভাব, প্রচার-প্রচারণার ঘাটতি এবং পরিকল্পনার স্বল্পতা—এসব কারণে জুড়ীর পর্যটন এখনো মূলধারায় আসতে পারেনি। উপজেলায় নেই মানসম্মত আবাসন, নিরাপদ খাবার হোটেল বা গাইড সেবা। বর্ষায় অনেক পথ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে, অধিকাংশ স্থানে দিকনির্দেশক সাইনবোর্ড বা তথ্যকেন্দ্রও নেই।
স্থানীয় পর্যটন উদ্যোক্তা ও পিক অ্যান্ড গো ট্যুরিজমের প্রতিষ্ঠাতা শাকিল আহমেদ বলেন, “জুড়ীকে যদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করে এবং গাইড প্রশিক্ষণ, রোড ম্যাপ, প্রচারণা ও ইকো-ট্যুরিজম নিশ্চিত করে, তবে খুব অল্প সময়েই জুড়ী দেশের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারবে।” তার মতে, জুড়ীতে পর্যটন উন্নয়ন হলে স্থানীয় কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।
উদীয়মান লেখক হাফেজ শামসুল ইসলাম মনে করেন, জুড়ীর সৌন্দর্য কেবল প্রাকৃতিক নয়; বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের সমন্বয় এ জনপদকে দিয়েছে অনন্য পরিচিতি।
পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, “পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক জুড়ীর পরিবেশ ও কৃষির জন্য ভয়াবহ হুমকি। পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারে সবাই সচেতন হলে এখানকার পর্যটনও হবে টেকসই।”
জুড়ীর পর্যটন উন্নয়ন বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাবলু সূত্রধর বলেন, “পাথারিয়া বনাঞ্চল সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে প্রবেশে কিছু বিধিনিষেধ আছে। তবে হাকালুকি হাওরকে কেন্দ্র করে সমন্বিত পর্যটন পরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে এবং তা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।”
সব মিলিয়ে প্রকৃতি, ঝর্ণা, পাহাড়, হাওর, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অপার সৌন্দর্যে জুড়ী একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন ভাণ্ডার। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি স্বীকৃতি এবং স্থানীয় অংশগ্রহণই পারে এই অবহেলিত জনপদকে পরিণত করতে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সময় এসেছে সবুজ-স্বর্গ জুড়ীকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে তোলার।

