রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে হাঁটলে প্রথমেই চোখে পড়ে রোগী আর স্বজনদের ক্লান্ত অপেক্ষা। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল প্রতিদিন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র—শয্যা সংকটে নাজেহাল রোগীরা জীবন রাখার ন্যূনতম সুযোগের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু অপেক্ষার শেষে মেলে না সমাধান; কখনও কখনও মেলে শুধু মৃত্যু সংবাদ।
কাগজে খুমেক ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। বাস্তবে প্রতিদিন রোগী থাকে তিনগুণ। সেই বিপুল চাপের বিপরীতে আইসিইউ বেড মাত্র ২০টি। শহরের আরেক সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ১০টি। খুলনা সদর হাসপাতালে নেই কোনো আইসিইউ সুবিধাই। ফলে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা—পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৬ লাখ মানুষের জন্য সরকারি পর্যায়ে কার্যকর আইসিইউ শয্যা মাত্র ৩০টি।
এই কঠিন বাস্তবতা অনেকের মতো বদলে দিয়েছে বরগুনার রোজিনা বেগমের জীবনও। গত ২৮ অক্টোবর অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছেলে আব্দুল্লাহকে নিয়ে ছুটে আসেন খুমেকে। জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ছটফট করছিল ছেলে। চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে নেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু হাসপাতালের সেই দরজা বারবার খুললেও রোজিনার জন্য খুলল না কোনো শয্যা।
২৯ অক্টোবর বারান্দার ঠান্ডা মেঝেতে শেষ নিঃশ্বাস নেয় আব্দুল্লাহ। রোজিনা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না—“যদি চেষ্টা করতে পারতাম, আইসিইউতে নিতে পারতাম, তারপরও যদি না বাঁচত... মনকে বুঝ দিতাম। কিন্তু সেই চেষ্টাটুকুও করতে পারলাম না।”
রোজিনা একা নন। ফুলতলার আমেনা খাতুন গত সপ্তাহে স্বামীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন বেড খোঁজার আশায়। কেউ বলেন বেড নেই, কেউ নাম লিখে যেতে বলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—জীবন কি অপেক্ষা করতে পারে?
এই সংকট নিয়ে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, “এটা উন্নয়ন বৈষম্যের নির্মম উদাহরণ। এত বড় অঞ্চলের জন্য ২০টি আইসিইউ—এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। সাধারণ মানুষ একদিনও টিকতে পারে না।”
সংকটের কথা স্বীকার করেই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আখতারুজ্জামান জানান, “প্রতিদিন রোগীর চাপ যে পরিমাণ, সেই হিসেবে আমাদের অন্তত ৫০–৬০টি আইসিইউ বেড প্রয়োজন। সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। বাজেট ও অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে।”
অন্যদিকে খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, “আমাদের এখানে জায়গা সীমিত। আইসিইউ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে ৬টি এইচডিইউ শয্যা যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।”
খুলনা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার মনে করেন, শুধু শয্যা সংকট নয়, জনবল ও মনিটরিং ব্যবস্থাও দুর্বল। তার ভাষায়, “রোগীর চাপ বিরাট। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ নেই। আইসিইউ শুধু চিকিৎসার জায়গা নয়—গুরুতর রোগীর শেষ ভরসা। সেই ভরসাই এখন টলে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে প্রতিদিনই আমরা আরেকটি ‘আব্দুল্লাহ’-কে হারাব। এই মৃত্যুগুলো এড়ানো যেত—যদি শয্যা আর কাঠামোটা একটু বড় হতো।”
খুলনার আইসিইউ সংকট আজ শুধু একটি হাসপাতালের সমস্যা নয়—এটি দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের প্রাপ্য ন্যূনতম চিকিৎসা অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার এক নির্মম চিত্র। শয্যা বাড়ানো, জনবল উন্নয়ন ও সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া এই দুঃস্বপ্নের শেষ নেই।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.