রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনা অঞ্চলে এইচআইভি–এইডস পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। শনাক্ত ও মৃত্যু—দুই সূচকই বাড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখনই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার না হলে আগাম দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের এআরটি সেন্টারে প্রতিদিনই বাড়ছে পরীক্ষার সংখ্যা। প্রতিদিন গড়ে ১০–১৫ জন পরীক্ষা করাতে আসছেন। পজিটিভ শনাক্ত হলে বিনা মূল্যে ওষুধ ও কাউন্সেলিং দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এই সেন্টারটি এখন খুলনা বিভাগ ছাড়িয়ে আশপাশের জেলার রোগীদেরও চিকিৎসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ হিসেবে দেখা যায়—২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৯ জনের রক্ত পরীক্ষা করে নতুন করে ১০০ জনের দেহে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছে। এ সময় মারা গেছেন ২৩ জন। যশোরে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি—৭ জন। খুলনায় ৪, নড়াইল ও সাতক্ষীরায় ৪ জন করে। বাগেরহাটে ২, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে একজন করে।
আগের বছর ৮৫ জন শনাক্ত হয়েছিলেন, মারা যান ২০ জন। অর্থাৎ সংক্রমণ যেমন বেড়েছে, মৃত্যুও বেড়েছে।
নতুন শনাক্তদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠী ৫৬ জন, সমকামী ৩৭ জন, রক্তের মাধ্যমে সংক্রমিত ৭ জন। জেলা ভিত্তিক হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে খুলনা—৪৯ জন। এরপর বাগেরহাট, নড়াইল ও সাতক্ষীরা।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু এক বছরের ব্যবধানে রক্ত পরীক্ষায় ৯ জনের শরীরে এইচআইভি ধরা পড়েছে; এদের বেশির ভাগই পুরুষ। তত্ত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম গাজীর মতে, সংক্রমিতদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। অনিরাপদ যৌনসম্পর্কই ঝুঁকির মূল কারণ। স্ক্রিনিংবিহীন রক্ত গ্রহণও সংক্রমণের পথ খুলে দিচ্ছে।
জাতীয় চিত্রটিও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, দেশে শনাক্তের হার গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২০ সালে শনাক্ত ছিলেন ৬৫৮ জন, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৩৮–এ। আক্রান্তদের বড় অংশের বয়স ২৫ থেকে ৪৯।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণ, মাদকসেবীদের মধ্যে ব্যবহৃত সুচের পুনর্ব্যবহার, অভিবাসীদের মাধ্যমে ভাইরাস বিস্তার এবং কম পরীক্ষা সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। সারা দেশে এখন ৮ হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন।
খুমেকের চিকিৎসকেরা বলছেন, এইচআইভি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য না হলেও ওষুধে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু অরক্ষিত যৌনসম্পর্ক বাড়ায় খুলনা অঞ্চলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে।
এআরটি সেন্টারের ফোকাল পারসন ডা. ইকবাল হোসাইন জানান, সীমান্তঘেঁষা জেলা হওয়ায় খুলনায় ঝুঁকিও বেশি। যৌনকর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা না থাকা, নিরাপত্তাহীন যৌন আচরণ এবং সমুদ্র–স্থলসীমান্ত দিয়ে আসা মানুষের পরীক্ষা না হওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। তিনি বলেন, ‘অরক্ষিত যৌনসম্পর্কই সংক্রমণের সবচেয়ে বড় কারণ।’ মা–শিশুর মধ্যেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
কাউন্সেলিং কক্ষে রোগীরা মানসিক চাপ নিয়ে আসেন। অনেকেই প্রথমবার পজিটিভ জেনে ভেঙে পড়েন। সেন্টারে আসার পর বুঝতে পারেন, নিয়মিত ওষুধে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর দিবেশ ওঝা জানান, সেন্টারে নিবন্ধিত রোগী আছেন ৮৮৭ জন। এর মধ্যে ৫৫০ জন নিয়মিত ওষুধ নিচ্ছেন। অন্যরা মারা গেছেন বা অন্য সেন্টারে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘শনাক্ত বাড়া মানেই চিকিৎসার আওতায় আসা বাড়া। আর সেটাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর উপায়।’
২০২০ সাল থেকে খুলনা অঞ্চলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছরই শনাক্ত বাড়ছে। ২০২০ সালে শনাক্ত ৩৬, ২০২১ সালে ২৮, ২০২২ সালে ৬৫, ২০২৩ সালে ৬৫ এবং ২০২৪ সালে ৮৫ জন। একইভাবে বাড়ছে মৃত্যুও।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মাহফুজা খাতুন বলেন, যত দ্রুত শনাক্ত হবে, তত দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সামাজিক লজ্জায় অনেকে চিকিৎসা নিতে পিছিয়ে যান। খুমেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়—এ কথা জানানো দরকার আরও বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরীক্ষা, সচেতনতা, নিরাপদ যৌন আচরণ এবং স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সময় এখনই—বিলম্ব মানে ঝুঁকি বাড়া।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.