রাসেল আহমেদ, খুলনা
খুলনার তেরখাদা উপজেলার শেখপুরা বাজারে বর্ষা মৌসুমেই জমে ওঠে ঐতিহ্যবাহী ‘নৌকার হাট’। শত বছরের পুরনো এই বাজারে এখনও প্রতি শুক্রবার বিক্রি হয় অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি নৌকা।
প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তেরখাদা উপজেলার আজগড়া ইউনিয়নের শেখপুরা বাজারে বসে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বড় মৌসুমি হাট—নৌকার হাট। আঠারোবেকি নদীর পাড় ঘেঁষা এই বাজার একসময় ছিল জলপথে আসা নৌকার মেলা, এখন রূপ নিয়েছে সড়কনির্ভর এক মৌসুমি বাণিজ্যে।
এই হাট ঘিরে শুধু নৌকা বিক্রিই নয়, তৈরি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানও। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে দূরের জেলার ব্যবসায়ীরাও এ হাটে এসে বিক্রি করছেন নিজ হাতে তৈরি নৌকা।
শুক্রবার (১ আগস্ট) সকালে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাগেরহাটের চিতলমারী, খুলনার পাইকগাছা, নড়াইলের লোহাগড়া, গোপালগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা থেকে শত শত মানুষ এসেছেন কাঙ্ক্ষিত নৌকা কিনতে।
ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে এসব নৌকার দাম ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা, তবে ভালো মানের বড় নৌকা বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ হাজার টাকায়ও।
বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে নৌকা নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মোঃ অলিয়ার শেখ জানান, ‘আমি আজ ২২টা নৌকা এনেছি, এর মধ্যে সকালেই বিক্রি হয়েছে ৮টা। প্রতিটা নৌকায় গড়ে ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।’
অন্য এক ব্যবসায়ী হাসান জানান, ‘আমরা তিন পুরুষ ধরে নৌকার কাজ করি। বাড়িতেই মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি করি নৌকা, এরপর শেখপুরা হাটে এনে বিক্রি করি।’
তেরখাদা উপজেলা সদরের জয়সেনা বাজারের কারিগর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সারা সপ্তাহে যত নৌকা তৈরি করি, সব বিক্রি হয় এই হাটে। মাঝে মাঝে অর্ডারেও বানাতে হয়।’
শেখপুরা হাটের ইজারাদার মোল্লা এস্কেন্দার নবধারাকে জানান, প্রতিটি নৌকার বিক্রয়মূল্যের ওপর শতকরা ৬ টাকা হারে খাজনা নেওয়া হয়। গড় হিসাব করলে প্রতি নৌকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খাজনা আদায় হয়। গরিব হলে ছাড়ও দেওয়া হয়।’
তাঁর ভাষায়, পুরো মৌসুমে এখানে অন্তত ৪০ কোটি টাকার নৌকা কেনাবেচা হয়। জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমজমাট থাকে হাট।
নৌকার হাট ঘিরে কর্মসংস্থান
নৌকা তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় গাছ কাটা, কাঠ সরবরাহ, স’মিল, কারিগর, পরিবহন, বিক্রয়, এমনকি চায়ের দোকান পর্যন্ত জড়িয়ে আছেন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। অনেকে আবার অর্ডারে নৌকা তৈরি করে সরবরাহ করছেন।
নৌকা কিনতে আসা তেরখাদা সদরের পশ্চিমপাড়া এলাকার পরিমল বৈরাগী জানান, ‘আমার মাছ ধরার কাজে নৌকা দরকার। বর্ষায় তো নৌকা ছাড়া চলাচলই বন্ধ হয়ে যায়। তাই আজ ৮ হাজার টাকায় কিনেছি।’
এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার সঙ্গে আজও অটুটভাবে জড়িয়ে আছে নৌকা। প্রযুক্তির উন্নয়ন হলেও গ্রামের মানুষের বাস্তবতায় এখনও নৌকাই নির্ভরতার নাম। আর শেখপুরার এই হাট টিকিয়ে রেখেছে নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও ঐতিহ্য।