মফিজুল ইসলাম ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
মাত্র একদিন বয়সী ছেলেকে কোলে নিয়েই বিদায়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলো অসহায় এক মাকে। দারিদ্র্য আর নিঃসহায় জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাঁকে বাধ্য করেছে সন্তানকে দত্তক দিতে। বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন হাসপাতালের বিল মওকুফ আর নগদ ৬৫ হাজার টাকা। হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার নেপার মোড়ের পিয়ারলেস প্রাইভেট হাসপাতালে।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মহেশপুর উপজেলার সুমাইয়া খাতুনের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার, যখন গর্ভাবস্থার চার মাসে হঠাৎ স্বামী আল-আমিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ঠাঁই হয়নি শ্বশুরবাড়িতে, আশ্রয় মেলেনি বাবার বাড়িতেও। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয় বৃদ্ধা নানির ঘরে।
৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে প্রসব বেদনা উঠলে এক প্রতিবেশীর সহায়তায় স্থানীয় ক্লিনিকে সিজারের মাধ্যমে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু জন্মের আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত হয় অশ্রুতে। দারিদ্র্য, ঋণের বোঝা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাঁকে এক ভয়াবহ সিদ্ধান্তে ঠেলে দেয়।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সুমাইয়া খাতুন বলেন—
“স্বামী মারা যাওয়ার পর আর কোথাও ঠাঁই পাইনি। ধারদেনা করে বেঁচে আছি। ক্লিনিকের খরচ জোগাড় করা, সন্তান মানুষ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই কষ্টের মাঝেই নবজাতককে দত্তক দিতে বাধ্য হয়েছি।”
তিনি জানান, শিশুটিকে দত্তক নিয়েছে কুমিল্লার একটি পরিবার, তবে তাঁদের পরিচয় জানেন না। এই লেনদেনে সহযোগিতা করেন ক্লিনিকের নার্স ইসমোতারা। হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে সুমাইয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয় ৬৫ হাজার টাকা।
১ অক্টোবর বিকেলে ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাদিজা আক্তার এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নিপার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ক্লিনিকের অনিয়ম ও খারাপ পরিবেশের প্রমাণ মেলে। এ কারণে ক্লিনিক মালিক সেলিম রেজা বাবুকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এদিকে শিশুবিক্রির সহযোগিতাকারী নার্স ইসমোতারাকে আটক করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
ইউএনও খাদিজা আক্তার বলেন, “শিশু বিক্রির মতো অমানবিক ঘটনায় কেউ ছাড় পাবে না। ক্লিনিক মালিককে সাজা দেওয়া হয়েছে, নার্সের বিরুদ্ধেও মামলা হচ্ছে।”
তবে ক্লিনিক মালিক সেলিম রেজা বাবু দায়িত্ব এড়াতে বলেন, “সিজারের পর রোগীর দেখাশোনার বাইরে আমার কিছু করার নেই। রোগী যদি নিজে সিদ্ধান্ত নেয়, তার দায় আমার নয়।”
অপরদিকে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নিপা নিশ্চিত করেছেন, অভিযানের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনাটি শুধু একটি শিশুর নয়, বরং সমাজের দারিদ্র্য, নিঃসহায়তা ও মানবিকতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। যেখানে মায়ের ভালোবাসা আর অর্থনৈতিক সংকটের সংঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে একটি নিষ্পাপ জীবনের ভবিষ্যৎ।