শাহজাহান হেলাল, মধুখালী
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের সালামতপুর গ্রাম—বর্তমান রউফনগরে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিবিজড়িত জন্মভিটা চরম অবহেলা ও অযত্নে ধ্বংসের পথে। দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির দরজা-জানালা চুরি হয়ে গেছে, ঘরের ভেতরে সাপ-বিচ্ছুর আবাস গড়ে উঠেছে। একসময় বিদ্যুৎ থাকলেও এখন সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের বাড়িতে যাতায়াতের একমাত্র সড়কটি আজও টেকসইভাবে পাকা হয়নি। প্রতি বছর মধুমতি নদীর ভাঙনে সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ভাঙন ঠেকাতে বোল্ডার, সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও স্থায়ী সমাধান হয়নি। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থী ও পর্যটকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বীরশ্রেষ্ঠের নামে থাকা যাদুঘর ও গ্রন্থাগারে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম। যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে কেবল তাঁর ব্যবহৃত দুটি বাটি ও একটি থালা—এর বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মারক নেই। জন্মভিটা রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় দর্শনার্থীরা এসে হতাশা ও বেদনা নিয়ে ফিরে যান।
স্থানীয়রা জানান, বীরশ্রেষ্ঠের মা মকিদুন্নেছা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। দুই বোনের মধ্যে বড় বোন জোহরা বেগম সালামতপুরেই বসবাস করেন, অন্য বোন হাজেরা বেগম থাকেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সাংগুড়া গ্রামে। পরিবারের সদস্যরা দুঃখ-কষ্টে দিন কাটালেও নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়ার নজির নেই। প্রতিবছর বীরশ্রেষ্ঠের জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী নামমাত্র কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
রউফনগরের বাসিন্দা রফিক হোসেন বলেন, “ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কামারখালী থেকে মধুমতি নদীর তীর ধরে এ গ্রামে আসতে হয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সড়কটি বেহাল। টেকসই পাকা সড়ক না হওয়ায় আমাদের ক্ষোভ বাড়ছে।”
গন্ধখালী গ্রামের নাসির হোসেন বলেন, “ছোটবেলা থেকেই রাস্তার এমন অবস্থা দেখছি—শুধু প্রতিশ্রুতি।”
বকশিপুর গ্রামের মো. বিল্লাল জানান, “এই রাস্তায় চলতে গিয়ে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে নারীদের চিকিৎসায় ভোগান্তির শেষ নেই।”
সালামতপুর গ্রামের শিক্ষার্থী পারভেজ বলেন, “বীরশ্রেষ্ঠের বাড়িতে থাকার মতো পরিবেশ নেই। জানালা-দরজা, এমনকি টিউবওয়েলের মাথাও চুরি হয়েছে। এভাবে চললে কিছুদিন পর বাড়ির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের বড় বোন জোহরা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, “এটা যে বীরশ্রেষ্ঠের বাড়ি—দেখে বোঝার উপায় নেই। কত মানুষ কষ্ট করে আসে, তারাও আফসোস করে। মায়ের মৃত্যুর পর আর তেমন কেউ খোঁজ নেয় না। দুঃখ-কষ্ট আগেও ছিল, এখনো আছে।”
মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রওশনা জাহান বলেন, “আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। মধুমতি নদীর ভাঙনের কারণে সড়কের উন্নয়ন করা কঠিন ছিল। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের বাড়ি ও গ্রন্থাগারের উন্নয়নে কী করা যায়, তা দেখা হবে।”
প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৮ মে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে। তিনি ১৯৬৩ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্ব পালনকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বুড়িঘাটে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে একাই প্রতিরোধ গড়ে তুলে শহিদ হন। তাঁর আত্মত্যাগে সেদিন প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়। তিনি জাতির সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ-এ ভূষিত হন।
এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ, জন্মভিটা সংস্কার এবং যাতায়াত সড়ক টেকসইভাবে উন্নয়নের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দ্রুত পদক্ষেপ দাবি জানিয়েছেন।

