শেখ আরিফুজ্জামান, কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা)
বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন চেতনায় জেগে উঠেছে কালিগঞ্জ উপজেলা। ২০২৪ সালের ‘জুলাই অভ্যুত্থান’কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যেমন গণজাগরণ তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তনের ছাপ। এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে কালিগঞ্জ উপজেলায় যোগদান করেছেন ৩৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা জনাবা অনুজা মণ্ডল।
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর কালিগঞ্জে ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অনুজা মণ্ডল। দায়িত্ব বুঝে নেন অমিত কুমার (ভূমি) এর কাছ থেকে। তার আগমনের সময়কালটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির, প্রশাসনিক স্থবিরতায় আচ্ছন্ন। অনেকে যেখানে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করেছেন, অনুজা মণ্ডল সেখানে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা দিয়ে কাজ শুরু করেন।
তিনি মনে করেন, ‘জুলাই বিপ্লব’ শুধু একটি রাজনৈতিক বাঁকবদল নয়, এটি জাতির নবজাগরণের প্রতীক। তার উদ্যোগে মাসব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়েছে চেতনা জাগানিয়া নানা কর্মসূচি—প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, দেয়ালিকা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক, আবৃতি ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
ইউএনও অনুজা মণ্ডল বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নয়নচেতনা জাগ্রত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। যত সুষ্ঠু প্রচার, তত দ্রুত প্রসার।”
তার নেতৃত্বে কালিগঞ্জে ফুটে উঠেছে জুলাই বিপ্লবভিত্তিক গ্রাফিতি। এসব গ্রাফিতিতে মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রতীক ব্যবহার করে বার্তা দেওয়া হয়েছে—শোষণ, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। তিনি বলেন, “মানুষ বেঁচে থাকে শুধু খাদ্য বা বাসস্থানের জন্য নয়, তারা চায় বাকস্বাধীনতা ও নিরাপত্তা।”
পরিবেশ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিও অত্যন্ত প্রগতিশীল। ইউএনও’র তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের মাঝে ফলজ ও বনজ গাছের চারা বিতরণ এবং স্কুলভিত্তিক গাছের রক্ষণাবেক্ষণের নিয়মিত মূল্যায়ন চালু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
কালিগঞ্জ উপজেলার বর্তমান চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন—নিচু ভূপ্রকৃতিজনিত জলাবদ্ধতা, সীমান্তঘেঁষা এলাকার মাদক ও চোরাচালান প্রবণতা, নিরাপদ পানির অভাব, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা। তবে তিনি আশাবাদী, এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তিনি বলেন, “সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করলে কালিগঞ্জ ‘সাদা স্বর্ণের স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হতে পারে।”
তিনি তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে জনগণের অংশগ্রহণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। “আমার কালিগঞ্জ, আমাকেই সাজাতে হবে”—এই বিশ্বাস থেকেই তিনি উপজেলাবাসী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “জুলাই বিপ্লব তখনই সার্থক হবে, যখন শিশুরা নিরাপদে ঘুমাতে পারবে, তরুণরা দুশ্চিন্তা ভুলে মাঠে খেলবে, এবং মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিরাপদে প্রার্থনা করতে পারবে।”
সর্বোপরি, ইউএনও অনুজা মণ্ডল কালিগঞ্জকে একটি আদর্শ, টেকসই ও মানবিক উপজেলায় রূপান্তরের স্বপ্ন দেখছেন। তার মতে, সমস্যা যেখানে, সম্ভাবনাও ঠিক সেখানেই। প্রয়োজন শুধু সমন্বিত উদ্যোগ ও দৃঢ় নেতৃত্ব।