রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনার গল্লামারী মোড়ে ময়ূর নদের তীরে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত লিনিয়ার পার্কটি বর্তমানে পরিচালনা করছেন বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের সাবেক দুই নেতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই পার্কটির দখল, ইজারা, বিনিয়োগ এবং দোকান নির্মাণ নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা ও বিতর্ক।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) ২০১২ সালে ১৪ একর জমিতে শুরু করে পার্কটির নির্মাণকাজ, যা শেষ হয় ২০১৩ সালে। এরপর ২০১৬ সালে মেসার্স ফারুক এন্টারপ্রাইজের মালিক ফারুকুল ইসলামের কাছে ১৫ বছরের জন্য পার্কটি ইজারা দেওয়া হয়। বার্ষিক ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভিত্তিতে ইজারার চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ার কথা। সর্বশেষ অর্থবছরে ইজারার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
পার্ক পরিচালনায় ইজারাদার ফারুকুল ইসলামকে সামনে রেখে বিনিয়োগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও কেসিসির কাউন্সিলর আলী আকবর টিপু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সোহেল, জাকির হোসেন, ফারুকুল ইসলাম চুনি ও ফারুক হোসেন। পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে তারা প্রায় ৩০ হাজার গাছ লাগানোসহ চিড়িয়াখানা, ট্রেনসহ নানা বিনোদনমূলক সরঞ্জাম সংযোজন করেন।
তবে ময়ূর নদে পানি প্রবাহ না থাকায় দুর্গন্ধ ও নোংরা পরিবেশে পার্কটি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে পারেনি। এর পাশাপাশি অশ্লীলতা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে পার্কটি ক্রমেই প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ফলে প্রায় ২০ লাখ টাকা ভাড়া বকেয়া পড়ে যায়।
২০২৪ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগপন্থী বিনিয়োগকারীরা আত্মগোপনে গেলে, চাপে পড়ে পার্কটির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেন ইজারাদার ফারুকুল ইসলাম। চলতি বছরের শুরুর দিকে সাবেক যুবদল নেতা মাহাবুব হাসান পিয়ারু এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের একরামুল হক হেলাল ফারুকের সঙ্গে একটি অপ্রকাশ্য চুক্তিতে পার্কটির নিয়ন্ত্রণ নেন।
যদিও ফারুক এখনও নামমাত্র ইজারাদার হিসেবে রয়েছেন, পার্কটি কার্যত পরিচালিত হচ্ছে পিয়ারু ও হেলালের তত্ত্বাবধানে। তারা জানান, পার্কের পূর্ববর্তী বিনিয়োগকারীরা তাদের ডাকেন এবং পরিচালনার অনুরোধ করেন। বর্তমানে তারা পার্কটি পরিচালনা করছেন এবং কেসিসিকে ২০ লাখ টাকার বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করেছেন বলেও দাবি করেন।
পার্কের ঠিক বাইরের অংশে—খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে কেসিসির জমিতে—সম্প্রতি ১৮টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দৈনিক ১০০ থেকে ২৫০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এই দোকান ভাড়া আদায় করছেন পিয়ারু ও হেলালের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেসিসির বৈষয়িক কর্মকর্তা গাজী সালাউদ্দিন বলেন, “আইন অনুযায়ী পার্ক সাব-লিজ বা অন্য কারও কাছে হস্তান্তরের সুযোগ নেই। যেহেতু ফারুকের নামে ইজারামূল্য পরিশোধ হচ্ছে, তাই তারাই চালাচ্ছেন বলে ধরা হয়। তবে কেসিসির জমিতে নির্মিত দোকানগুলো অবৈধ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো অপসারণের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে।”
কেসিসির ইজারা চুক্তির ৫ নম্বর শর্তে বলা আছে, পার্কের দক্ষিণ পাশে মহাসড়কের পাশের ফাঁকা জায়গা ইজারার আওতায় থাকবে না। আর ১৭ নম্বর শর্ত অনুযায়ী, পার্কটি কোনোভাবেই সাব-লিজ দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ, পার্ক হস্তান্তর এবং দোকান নির্মাণ—দুটিই শর্তভঙ্গ।
ফারুকুল ইসলাম বলেন, “গত ডিসেম্বরে পার্ক ছেড়ে দিয়েছি। নতুন পরিচালনার দায়িত্বে কারা আছেন, সেটি তারাই বলবেন। বিনিয়োগের কিছু টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও গত ৯ মাসে এক টাকাও পাইনি।”
মাহাবুব হাসান পিয়ারু ও একরামুল হক হেলাল বলেন, “আমরা পার্কে বিনিয়োগকারীদের অনুরোধেই দায়িত্ব নিয়েছি। পরিবেশ উন্নত করেছি, বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করেছি। সাব-লিজ দেওয়া যায় না বলেই এখনও ফারুকের নামে লাইসেন্স রয়েছে। দোকানগুলো স্থানীয় অসহায় ব্যবসায়ীদের অনুরোধে অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আয় কম হওয়ায় সেখানকার ভাড়া থেকেই কেসিসিকে ইজারামূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে।”
অন্যদিকে, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক তৈয়েবুর রহমান বলেন, “পিয়ারু ও হেলাল আমার বন্ধু। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকলে ওদের চালাতে দিত না কেউ। আমার নাম ভাঙিয়ে কথা বলা হলেও পার্ক ইজারা বা দোকান ভাড়ার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”