রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা এক সময় ছিলেন গৃহস্থালির কাজেই সীমাবদ্ধ। পরিবার চালানোর একমাত্র ভরসা ছিলেন তাদের স্বামী। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তারা নিজেরাই ঘেরে চিংড়ি ও মাছ চাষ করে সংসার চালাচ্ছেন, সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, এমনকি সঞ্চয়ও করছেন। এই বদলের পেছনে কাজ করছে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ, ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা।
গোনালী গ্রামের সাবিনা বেগম জানালেন, “আগে আমার স্বামীর টাকার ওপরই নির্ভর করতে হতো, প্রতিটি খরচের হিসাব দিতে হতো। যখন উপার্জনের সুযোগ পেলাম, চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি। এখন নিজের আয়ে চলি, সঞ্চয়ও করতে পারি।” সাবিনা ডুমুরিয়া উপজেলার কোস্টাল প্রকল্প থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজ ঘেরে চিংড়ি চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তার স্বামীও আর সাগরে মাছ ধরতে যান না। কখনো ঘেরে সহায়তা করেন, কখনো ভ্যান চালান।
আরাজি-সাজিয়াড়ার সোনিয়া বেগমও মাছ চাষের মাধ্যমে নিজের জীবন বদলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আগে আমাদের পুরুষরা নদীতে যেত, এখন আমরা নিজেরা ঘেরে কাজ করছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি।” তিনি ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘেরে মাছ চাষ শুরু করেন এবং এর আগে মৎস্য বিভাগের প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।
মাগুরাঘোনা গ্রামের খাদিজা বেগম, যিনি বাগদা-গলদা সিবিও-এর সহ-সভাপতি, বললেন, “আমাদের এলাকায় এক হাজারেরও বেশি চিংড়ি ঘের আছে। কিন্তু মৎস্য অফিসের উৎসাহে আমরা প্রথমবার ১৫ জন মহিলা ও ১০ জন পুরুষ মিলে একটি ঘের তৈরি করেছি। আধুনিক চাষ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা এবং নেতৃত্ব বিকাশ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। আশা করছি, আমরা নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারব।”
রুদাঘরা গলদা-বাগদা সিবিও-এর সভাপতি মুক্তা বিশ্বাস জানান, “উপজেলা মৎস্য অফিসের সহায়তায় আমাদের প্রকল্প ভালোভাবে এগিয়ে চলছে। সব লেনদেন আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে করি। এই সমিতির মাধ্যমে এলাকার মহিলারা নতুন স্বপ্ন নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।” তিনি জানান, তিনি ২৫ জন সদস্যের একটি মৎস্যচাষি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ফিলিপাইন গিয়ে উন্নত চাষ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগও পেয়েছেন।
শোভনা বাগদা সিবিও-এর কোষাধ্যক্ষ খাদিজা বেগম বলেন, “আমরা ১৩ জন মহিলা ও ১২ জন পুরুষ মিলে শোভনা পশ্চিমপাড়ায় একটি ঘের লিজ নিয়েছি। সরকারি সহায়তায় এই প্রথম এমন প্রকল্প আমাদের এলাকায় এসেছে। অফিস থেকে হাতে-কলমে চিংড়ি চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি।” তিনি আরও জানান, “প্রকল্পের আওতায় সাইনবোর্ড, নেট, চুন, পালিশ কুড়া, ইস্ট, সার, খৈল, মাছ ও চিংড়ির পিএল এবং খাবার পেয়েছি। এই সহায়তা পেয়ে আমরা এখন আত্মবিশ্বাসী। আশা করছি, নিজেদের ঘাম ও পরিশ্রমে আমরা আমাদের জীবনমানের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারব।”
এইসব উদ্যোগের নেতৃত্বে আছেন ডুমুরিয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার সোহেল মোঃ জিল্লুর রহমান রিগান। তিনি জানান, “মৎস্য অধিদপ্তরের ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিস’ এবং ‘কমিউনিটি বেইজড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডুমুরিয়ার প্রান্তিক ও জেলে সম্প্রদায়ের নারীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতে করে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত হচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “নারীরা এখন শুধু নিজেদের পরিবারে নয়, সমাজেও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করছেন। এই পরিবর্তন একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।”
ডুমুরিয়ার গ্রামেগঞ্জে ঘুরে দেখা যায়, যারা এক সময় গৃহের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন, তারা এখন নিজের ঘেরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করছেন। এই নারীরা শুধু মাছ চাষ করছেন না, তারা নিজেদের হাতে গড়ে তুলছেন আত্মনির্ভরশীলতার এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.