যশোর প্রতিনিধি
যশোরের তরুণ গাছি আবদুল কুদ্দুস (৩৫)। বাপ-দাদার পেশার হাল ধরেছেন তিনি। এ বছর তিন শতাধিক খেজুর গাছের রস থেকে তিনি গুড়-পাটালি তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছেন। চাহিদা বেশি থাকায় এবার গুড় উৎপাদনের দ্বিগুণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। গত বছর তিনি প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার গুড়-পাটালি বিক্রি করেছিলেন। গুড়ের মান ভালো হওয়ায় ইতোমধ্যে আগাম অর্ডারও পেয়েছেন। সপ্তাহখানেক পরেই শুরু হবে তার গাছের রস থেকে গুড়-পাটালি উৎপাদন।
যশোরের চৌগাছার চাকলা গ্রামের মোস্তফা মণ্ডলের ছেলে আবদুল কুদ্দুস বলেন, দাদা হবিবর মণ্ডল খেজুর গাছের রস থেকে গুড়-পাটালি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দাদার সঙ্গে বাবাও যুক্ত ছিলেন। এখন দাদা বেঁচে নেই। সময়ের পরিক্রমায় বাবার পেশায় আমিও যুক্ত হয়েছি। বাবা আর আমি এবার তিনশ খেজুর গাছের রস থেকে গুড়-পাটালি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের মানসম্মত গুড়-পাটালির সুনাম আছে। মান ধরে রেখে ভোক্তার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করব।
শুধু গাছি আবদুল কুদ্দুস নয়, যশোরের প্রায় ছয় হাজার গাছি খেজুর গাছের রস থেকে গুড়-পাটালি উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে খেজুর গাছ তোলা (রস সংগ্রহের জন্য পরিষ্কার) কাজ শুরু হয়েছে। অনেকেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহের উপযোগী করে ফেলেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে রস সংগ্রহ শুরু হবে। এ বছর যশোরের খেজুর গুড় বাংলাদেশর ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এই শিল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। জিআই পণ্য হিসাবে খেজুর গুড়ের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, যশোর জেলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে রস আহরণের উপযোগী গাছের সংখ্যা তিন লাখ সাত হাজার ১৩০টি। গাছ থেকে তিন কোটি ৭১ লাখ তিন হাজার লিটার রস ও দুই হাজার ৭৪২ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজার দর অনুযায়ী প্রতি লিটার রসের দাম ৩৫ টাকা ও গুড়ের কেজি ৩৪০ টাকা। সেই হিসাবে রস ও গুড়ের বাজার দর ৯৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। রস গুড় হাত বদলের সঙ্গে বাজার আরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। গাছ তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
চৌগাছার পিতম্বরপুর গ্রামের গাছি মিজানুর রহমান (৭০) বলেন, সবাই গাছ তুলতে (রস সংগ্রহের উপযোগী) পারে না। আমি প্রায় ৫০ বছর ধরে এই কাজ করি। প্রতিটি গাছ তুলতে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত নিই। এখন বয়স হয়েছে, এজন্য বেশি কাজ করতে পারি না। গাছ তোলার পর চাঁচ (আবার পরিষ্কার) করা হবে। এরপর নলি বসানো হয়। তারপর থেকে রস সংগ্রহ শুরু হবে।
গাছিরা জানান, কার্তিক মাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই খেজুর গাছ ছেঁটে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। কারণ শীত মৌসুমে এ অঞ্চলের কৃষকদের অন্যতম আয়ের উৎস এটি। শীতে খেজুরের রস গ্রামীণ জনপদে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। শীতের আমেজ পায় পূর্ণতা। শীত বাড়ার সঙ্গে বাড়ে রসের মিষ্টতাও। এ জনপদে শীতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দিনের শুরুতে খেজুরের রস, সন্ধ্যায় রস ও গুড়-পাটালি। পিঠা ও পায়েস তৈরিতে আবহমানকাল থেকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খেজুরের গুড় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার কারিগরদের দানা পাটালি তৈরির সুনাম রয়েছে। পাটালি ও ঝোলা গুড় তৈরি ছাড়াও চাষিরা শীতের ভোরে ফেরি করে কাঁচা রস বিক্রি করেন। কাঁচা রস প্রতি মাটির ভাড় ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দানা গুড় ৩৫০-৪০০ টাকা, আর পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।
খেজুর গুড় বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কেনারহাটের উদ্যোক্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমাদের কাছে ভোক্তার চাহিদা ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজি গুড় পাটালি। সরবরাহ করতে পেরেছিলাম দুই হাজার কেজি। এ বছরের গুড়-পাটালির জন্য ইতোমধ্যে অর্ডার আসতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, খেজুর গুড়ের যেমন ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও রয়েছে। জিআই পণ্য হিসাবে নিরাপদ খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ, প্রশিক্ষণও উঠান বৈঠকে উদ্বুদ্ধ করছি। আশা করছি, নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদন হবে। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.