রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনার রাজনীতির বাতাসে ফের অস্থিরতা। বহুদিনের চাপা ক্ষোভ যেন আবারও আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপির ভেতরে। সাবেক সংসদ সদস্য ও নগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে খুলনা-২ (সদর) আসনের প্রার্থী ঘোষণা করার পর থেকেই আনন্দ, ক্ষোভ আর হতাশা মিলেমিশে এক অস্বস্তিকর দৃশ্য তৈরি করেছে মহানগর বিএনপিতে। যিনি একদল কর্মীর কাছে আশার প্রতীক, অন্য দলের কাছে তিনিই এখন তিক্ততার নাম।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তখন খুলনা বিএনপিতে দেখা দিয়েছে উল্টো চিত্র। বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের পৃথক কর্মসূচি এখন দলের মাঠে বিভক্তির সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে কটাক্ষ, পাল্টা বক্তব্য আর ব্যক্তিগত আক্রমণ—যেন এক রাজনৈতিক পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ্য নাট্যমঞ্চ।
মহানগর বিএনপির এই দ্বন্দ্ব নতুন নয়। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর থেকেই সংগঠনটি দুই ভিন্ন শিবিরে বিভক্ত। একপক্ষে বর্তমান সভাপতি শফিকুল আলম মনা ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন, অন্যপক্ষে সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিন বছর ধরে কেন্দ্রীয় ও দিবসভিত্তিক কর্মসূচি তারা পৃথকভাবে পালন করে আসছেন। এ বছরের শুরুতে খুলনা-২ আসনে প্রার্থী হতে মাঠে নামেন তুহিন। পরে একই ঘোষণা দেন সভাপতি মনা। আর মঞ্জু
যিনি আগে থেকেই সক্রিয় ছিলেন—তিনি তার পুরনো জনপ্রিয়তা নিয়ে ধীরে ধীরে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে ফিরে আসেন।
দলের তিন প্রভাবশালী নেতা যখন আলাদা পথে চলছিলেন, তখনই শুরু হয় প্রতিযোগিতা, একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। শেষ পর্যন্ত গত ৩ নভেম্বর বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়া হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুর হাতে। এরপর থেকেই তার অনুসারীদের উল্লাসে ভরে ওঠে নগরের রাজপথ, আর হতাশার ছায়া নেমে আসে বর্তমান কমিটির নেতাদের মুখে। প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে তিন নেতার মধ্যে এখনো কোনো যোগাযোগ হয়নি, বরং বিপ্লব দিবস উপলক্ষে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে তারা নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করছেন।
এই পরিস্থিতিতে নগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সবাইকে একসঙ্গে বসে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু তিনি (মঞ্জু) এখনো কোনো যোগাযোগ করেননি। আমিও করিনি। দলের মূল নেতৃত্ব হিসেবে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি করা আমাদের দায়িত্ব, আমরা সেটাই করেছি। কেউ যদি পাল্টা কর্মসূচি দেয়, তার দায় তার নিজের।
নগর সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেন, দীর্ঘ ৪২ বছর বিএনপির রাজনীতিতে আছি, ১০৯টি মামলার আসামি হয়েছি, ৯ বার জেল খেটেছি। মনোনয়ন না পেয়ে কষ্ট পেয়েছি ঠিকই, তবে আক্ষেপ নেই। দল যাকে প্রার্থী করেছে, তার পক্ষেই কাজ করব। কিন্তু মনোনীত প্রার্থীরও উচিত ছিল সবাইকে সঙ্গে নেওয়া। টেলিভিশনে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দেওয়া যায়, অথচ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয় না—এটা সত্যিই কষ্টদায়ক।
অন্যদিকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসা নজরুল ইসলাম মঞ্জু জানালেন, তিনি এখনো শারীরিকভাবে দুর্বল। “গত ২৯ অক্টোবর থেকে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছি,” বললেন তিনি। “এখনও দুর্বলতা অনুভব করছি, তাই বাইরে বের হতে পারছি না বা কারও সঙ্গে যোগাযোগও হয়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল খুলনায় আসলে সবাইকে নিয়ে বসার পরিকল্পনা আছে।”
পৃথক কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিএনপির পদবঞ্চিত নেতারা আগেও আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করেছেন। ৭ নভেম্বরের আগে যদি বসার সুযোগ হয়, তাহলে একসঙ্গেই কর্মসূচি পালন করা হবে।
এদিকে সামাজিক মাধ্যমে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মঞ্জুর অনুসারী জসিম উদ্দিন। তিনি লিখেছেন, “যারা দলবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের ঘাড় ধরে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে।” তার এই মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মনা–তুহিন শিবিরের নেতারা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, খুলনা বিএনপির এই দীর্ঘদিনের বিভাজন এবার আরও গভীর রূপ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঐক্যের বার্তা দিলেও স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। দলের তিন প্রভাবশালী নেতার পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আলাদা অবস্থান শুধু সংগঠনের ক্ষতিই বাড়াচ্ছে।
খুলনার রাজনীতি এখন এক অদ্ভুত সমীকরণে দাঁড়িয়ে—যেখানে একপক্ষের উৎসব অন্যপক্ষের বিষাদে পরিণত হয়েছে। নজরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি নতুন আশার মুখ দেখলেও সেই আশার আকাশে এখনো ঘন কালো মেঘের ছায়া।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মেহেদী হাসান
কার্যালয়ঃ দেশ ভিলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিয়া সড়ক, জিটি স্কুল সংলগ্ন, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
মোবাইলঃ ০১৭১৮-৫৬৫১৫৬, ০১৯৯৫-৩৮৩২৫৫
ইমেইলঃ mehadi.news@gmail.com
Copyright © 2025 Nabadhara. All rights reserved.