রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনা মহানগর আবারও পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে। পুরনো ও নতুন সন্ত্রাসীচক্রের দাপটে থমকে গেছে শহরের স্বাভাবিক জীবন। খুন, গুলি, বোমা হামলা ও চাঁদাবাজিতে একের পর এক রক্তাক্ত ঘটনার পর নগরবাসী আজ ভয়ে নিস্তব্ধ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে—বর্তমানে মহানগরীতে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ১২টি সন্ত্রাসীচক্র, যার মধ্যে ‘আশিক’, ‘নূর আজিম’, ‘হুমা’ ও ‘গ্রেনেড বাবু’ চক্রের প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ।
গত ৬ অক্টোবর রাত পৌনে ৮টার দিকে নগরীর ২ নম্বর কাস্টমঘাটে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ইমরান মুন্সি (৩৫) নামে এক যুবককে। নিহত ইমরান ছিলেন স্থানীয় মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা। পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ‘পলাশ চক্র’। নিহত ইমরান নিজেও ছিলেন ‘গ্রেনেড বাবু’ গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সদস্য। নগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বই এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ।
এরপর ২ নভেম্বর আড়ংঘাটা থানার যোগীপোলে বিএনপি কার্যালয়ে বোমা ও গুলির হামলায় নিহত হন স্থানীয় নেতা মামুন শেখ। এই হামলাতেও সন্দেহের তীর একই চক্রগুলোর দিকেই। স্থানীয় সূত্র বলছে, নগরজুড়ে এখন সন্ত্রাসের রাজত্ব—একটি চক্র অন্যটিকে ঠেকাতে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে।
পুলিশের তালিকায় দেখা গেছে, খুলনায় সক্রিয় চক্রগুলোর মধ্যে মিরাজ, সজিব, বডি রাকিব, মোটা সবুজ, চিংড়ি পলাশ, হাড্ডি সাগর, ঢাকাই শামীম, শেখ পলাশ, কালা লাভলু নামের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা নিয়মিত সক্রিয়। খুন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসায় তারা এখন পুরো নগরজুড়ে ত্রাসের নাম।
সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে পরিচিত আশিক চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন চানমারী এলাকার আশিক। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এরপর একে একে গড়ে তোলেন নিজের বাহিনী। বিভিন্ন থানায় তাঁর নামে রয়েছে ১২টি মামলা। দলের সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ২৬ জন। সহযোগী ফয়সাল দক্ষিণ টুটপাড়ার বাসিন্দা। আশিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি মাদক ও অস্ত্র কারবারের পাশাপাশি ভাড়াটে খুনের দুনিয়ায়ও সক্রিয়।
শেখ নূর আজিম, টুটপাড়ার বাসিন্দা। ২০১৬ সালে কিশোর গ্যাং গঠন করে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন। আজ তাঁর হাতে রয়েছে একটি শক্তিশালী অস্ত্রচক্র। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই দলই বর্তমানে সবচেয়ে সশস্ত্র ও প্রভাবশালী। নূর আজিমের নামে অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে।
দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নিয়োজিত হুমা চক্রের নেতৃত্বে আছেন হুমায়ুন কবির হুমা (৩৭)। মতলেব শেখের এই ছেলে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িত। তাঁর নামে রয়েছে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলা। গত বছর বাগেরহাটের রামপালে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি, কিন্তু জামিনে বেরিয়েই ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড—যেমন যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা ও শিক্ষক ইমদাদুল হক হত্যায়—হুমা চক্রের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট।
দশকের পর দশক ধরে নগরীর অপরাধ জগতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে গ্রেনেড বাবু চক্র। নেতৃত্বে রয়েছেন রনি চৌধুরী ওরফে বাবু, যিনি ২০১০ সালে জাহাঙ্গীর হোসেন কচি নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে হত্যা করেন। সাজাপ্রাপ্ত হলেও তিনি এখনো পলাতক। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা আজও নগরীর ভেতরে-বাইরে সক্রিয়, বিশেষ করে মাদক কারবারে।
দলীয় কোন্দলে দুর্বল হলেও ফের আলোচনায় এসেছে পলাশ চক্র। সম্প্রতি কারাগারে গ্রেনেড বাবুর সহযোগী কালা তুহিনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এই চক্রের সদস্যরা। কারারক্ষীদের হস্তক্ষেপে সংঘর্ষ থামলেও নগরীতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়।
খুলনা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখন এক চক্র আরেক চক্রের ওপর হামলা চালাচ্ছে আধিপত্য নিয়ে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের লড়াই।” তিনি আরও জানান, “অপরাধীরা এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সরে যায়। ফলে তাদের ধরতে সময় লাগছে। স্থানীয় মানুষও ভয় পেয়ে তথ্য দিতে রাজি হন না।”
খুলনা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, “পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে। নির্বাচনের আগে যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে।”
তবে শহরের মানুষ বলছেন, রাতে দরজা বন্ধ করেও এখন নিরাপত্তা নেই। সন্ত্রাসীরা যখন খুশি গুলি চালাচ্ছে, বোমা ফাটাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে নীরব। দীর্ঘ দেড় দশক পর খুলনা যেন আবার ফিরে যাচ্ছে অন্ধকারের সেই পুরনো অধ্যায়ে—যেখানে ভয়ই ছিল একমাত্র বাস্তবতা।

