রাসেল আহমেদ,খুলনা প্রতিনিধি
খুলনায় আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণযুদ্ধ। একসময় চরমপন্থী তৎপরতা, খুনোখুনি ও আধিপত্য দখলের কারণে আতঙ্কের জনপদ ছিল যে অঞ্চল, সেখানে আবারও ফেরত এসেছে রক্তাক্ত সেই অতীতের আবহ।
১৯৯৯ থেকে ২০০৬—এই দীর্ঘ সময় জুড়ে রাজনৈতিক প্রভাব, চাঁদাবাজি, চরমপন্থী বিভাজন আর প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয়েছে খুলনা। যৌথ বাহিনী, র্যাব ও পুলিশের কঠোর অভিযানের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও গত দেড় বছরে নগর ও জেলার চিত্র আবারও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমানে কমপক্ষে ছয়টি সন্ত্রাসী বাহিনী—গ্রেনেড বাবুর ‘বি কোম্পানি’, হুমা বাহিনী, আশিক বাহিনী, পলাশ বাহিনী, নুর আজিম বাহিনী এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সেকেন্ড ইন কমান্ড আরমানের গ্রুপ—নিজেদের আধিপত্য ও মাদকবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এর মধ্যে নুর আজিম ও আরমান কারাগারে থেকেও বাহিনী পরিচালনার নির্দেশ দিচ্ছে বলে দাবি তদন্তকারীদের।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অবস্থার অবনতি দ্রুত বাড়তে থাকে। দেড় বছরে খুলনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৯৫ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে মাদকবাজার দখলের লড়াইয়ের। প্রতি মাসে ৭০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মাদক লেনদেনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার প্রতিযোগিতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ—পুলিশের টহল কমে যাওয়া ও র্যাবের অভিযান হ্রাস পাওয়ার সুযোগে সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) রাশিদুল ইসলাম বলেন, “খুলনার বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ মাদকবাজারের নিয়ন্ত্রণ। আধিপত্য দখল ও লেনদেন বণ্টন নিয়ে বিরোধ বাড়তেই সংঘর্ষ তীব্র হচ্ছে।”
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর শুধু নগরীতেই হত্যা মামলা হয়েছে ৫০টি, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গ্রেপ্তার হয়েছে দেড় শতাধিক আসামি এবং ১৫ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ভারতীয় রিভলভার, বিদেশি পিস্তল, রাইফেল, পাইপগানসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।
গোয়েন্দারা বলছেন, গ্রেনেড বাবু একাই খুলনার মাদকবাজারের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় পাঁচ শতাধিক সদস্যের বিশাল সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে সে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক তালিকায় নাম থাকলেও গ্রেনেড বাবু ও আশিক এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
গ্রেনেড বাবুর চাচাতো ভাই এবং নগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে কেএমপি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও পাঠিয়েছে বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে অনুমতি আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
দৌলতপুর, খানজাহান আলী ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে হুমা ও আরমান বাহিনী। বিশেষ করে মহেশ্বরপাশা এলাকায় গত সাড়ে তিন মাসে তিনটি হত্যাকাণ্ড, কয়েকজনকে কুপিয়ে জখম করা এবং প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণের মতো ঘটনা মানুষের ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ—কারাগার থেকে বের হওয়ার পর হুমায়ুন কবির হুমা নতুন করে আধিপত্য বিস্তারে মাঠে নামে, আর সঙ্গীরা তার ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর মহেশ্বরপাশার দুইটি বাড়িতে ১৫ রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনাতেও হুমা বাহিনীর সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। সে ঘটনায় ওসমান ও সেলিম নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে আরমান বাহিনী রাতের অন্ধকারে তৎপরতা চালাচ্ছে কারাগার থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ী।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও জানান, ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসীদের হাতে নতুনভাবে এসেছে মেইড ইন ইন্ডিয়া অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সীমান্ত ঘেঁষা জেলার দুর্বলতার সুযোগে এসব অস্ত্র কিশোর গ্যাং ও উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে।
কেএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) রাশিদুল ইসলাম বলেন, “বেশির ভাগ অস্ত্রই ভারত থেকে ঢুকছে। মাদক সিন্ডিকেট এসব অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করছে। অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চলছে।”
কেএমপির সহকারী কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড সিপি) ত ম রোকনুজ্জামান বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ছয়টি বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। মাদকবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তারা খুন-খারাপিতে জড়িয়ে পড়ছে। চোরাচালানের মাদক কারবারই এখন নগরীর অপরাধের মূল চালিকাশক্তি।
কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা পেশাদার অপরাধী। দ্রুত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারপরও অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারেও চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর। তবে জনগণের সহযোগিতাও জরুরি। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় তথ্যবাক্স বসানো হয়েছে। যে কেউ তথ্য দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

