যশোর প্রতিনিধি
যশোরে মানবপাচার চক্রের চার সদস্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রলোভনে রাশিয়ায় নিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই চক্রের শিকার হয়েছেন যশোরের জাফর হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজন। গত মঙ্গলবার (২৪ জুন) জাফরের ভাই সদর উপজেলার বড় মেঘলা গ্রামের বজলুর রহমান যশোর আদালতে এই মামলা দায়ের করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাফর হোসেনসহ অনেকেই বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে কাজ করছেন এবং তারা এখন একটি বাঙ্কারে অবস্থান করছেন।
যশোরের মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক ড. মো. আতোয়ার রহমান এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে সিআইডি পুলিশকে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। বাদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার কাজী মো. রেজওয়ান সেতু এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন: নড়াইলের কালিয়া উপজেলার কলাবাড়িয়া পশ্চিম পাড়ার আশরাফ মোল্যার ছেলে ও ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম আবুল হাসান, তার পার্টনার ঢাকার দক্ষিণখান থানার আশকোন এলাকার শহিদুল ইসলামের মেয়ে ফাবিহা জেরিন তামান্না, চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার মাঝেরপাড়া এলাকার মো. ইসহাকের ছেলে আলমগীর হোসেন দেলোয়ার, এবং ঢাকার নয়া পল্টন এলাকার মাহাতাব সেন্টার ভবনের ভ্যাকেশন প্লানারের মালিক শফিকুর রহমান।
বজলুর রহমানের অভিযোগ অনুযায়ী, আসামি এস এম আবুল হাসান এবং ফাবিহা জেরিন তামান্না তার ভাই জাফর হোসেনকে রাশিয়ায় ক্লিনার অথবা শেফস অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে মাসিক এক লাখ ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। এজন্য তারা জাফর হোসেনের কাছ থেকে মোট সাত লাখ ১০ হাজার টাকা নেন। বলা হয়েছিল, সরাসরি রাশিয়ায় যাওয়া যাবে না, প্রথমে তাকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখান থেকে ভিসা সংগ্রহ করে রাশিয়ায় পাঠানো হবে।
২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর উল্লিখিত আসামিরা জাফর হোসেনসহ চাকরিপ্রত্যাশী ১০ জনকে প্রথমে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেন। সৌদি আরব থেকে তাদেরকে গ্রহণ করেন আসামি শফিকুর রহমান। দুই মাস সৌদি আরবে থাকার পর একই বছরের ২২ ডিসেম্বর শফিকুর রহমান জাফর হোসেনসহ ১০ জনকে রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে নিয়ে যান। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর অপর আসামি আলমগীর হোসেন দেলোয়ারসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাদেরকে গ্রহণ করে নিজেদের হেফাজতে রাখেন।
এরপর আলমগীর হোসেন দেলোয়ার এবং তার সঙ্গীরা তাদেরকে জানান যে, আর্মি ক্যাম্পে ক্লিনার বা শেফস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার আগে সবাইকে ২০ দিনের ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হবে। এই কথা বলে তারা জাফর হোসেনসহ ১০ জনকে রাশিয়ার একটি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর জাফর হোসেনসহ অন্যরা জানতে পারেন যে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে অংশগ্রহণ করানোর জন্য ২০২৬ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এক বছরের জন্য জনপ্রতি ১৪ হাজার ডলারে আসামি আলমগীর হোসেন দেলোয়ার ও শফিকুর রহমান চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ফলে তারা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন।
বিষয়টি জানতে পেরে আকরাম হোসেন নামে এক যুবক কৌশলে আর্মি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এরপর জাফর হোসেনসহ অন্যরাও রাশিয়ার আর্মির নির্যাতনের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হন।
বর্তমানে জাফর হোসেন ইউক্রেনের ডোনেৎস্ক শহরের একটি যুদ্ধ ক্যাম্পের মাটির নিচের বাঙ্কারে অবস্থান করছেন। সেখানে ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় তার ডান পায়ের পাঁজড় ও উরুতে বোমার স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসা শেষে তাকে পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। সর্বশেষ জাফর হোসেনের সঙ্গে সোহান মিয়া নামে এক যুবক গত ২০ জুন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে জাফর হোসেন তার ভাই বজলুর রহমানকে এই তথ্য জানিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আকুতি জানিয়েছেন।