শামসুল হক ভূঁইয়া,গাজীপুর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম সিনেট অধিবেশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ২৯ হাজার টাকার ঘাটতি বাজেট অনুমোদন করা হয়েছে। একই সাথে, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত এই সিনেট অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, “শিক্ষার্থীদের দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে বিদেশে মানসম্মত চাকরির ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম হবে।” তিনি জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুণগত, মানসম্পন্ন, জ্ঞাননির্ভর, সৃজনশীল, দক্ষতাভিত্তিক ও কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিতে ব্যাপক সংস্কারমূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান:
উপাচার্য ড. আমানুল্লাহ জোর দিয়ে বলেন, সময়োপযোগী দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা দেশে ও দেশের বাইরে ভালো মানের ও আকর্ষণীয় বেতনের চাকরির সুযোগ এবং অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ নিশ্চিত করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, স্কিল বেইজড কারিকুলাম প্রণয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা গড়ে তোলা গেলে বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলিত কোর্সের সাথে অন্তত দুইটি প্রফেশনাল/কারিগরি/ভোকেশনাল কোর্স যুক্ত করে কারিকুলাম সংস্কার করছে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকেই নতুন কারিকুলাম কার্যকর করার চেষ্টা চলছে বলেও তিনি জানান।
শিক্ষার্থীদের মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী ভবিষ্যতে পেশা নির্বাচনে পরামর্শ প্রদানের জন্য অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ক্যারিয়ার ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে BYLC Career Center-এর সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার আওতায় প্রথম পর্যায়ে BYLC ১০০টি কলেজে ক্যারিয়ার ক্লাব গঠনের জন্য কক্ষ তৈরি করে দেবে। ইতোমধ্যে রাজধানীর লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজে প্রথম ক্যারিয়ার ক্লাব চালু হয়েছে।
শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ:
সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের অনার্স কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে, যা দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। কারিকুলাম সংস্কারের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষা Examination Management System (EMS)-এর আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া কলেজ র্যাঙ্কিং, মডেল কলেজ নির্বাচন ও ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নামে বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও গবেষণা:
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে বগুড়া ও হবিগঞ্জে নতুন আঞ্চলিক কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এছাড়াও কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। হবিগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে এবং দেশের সব জেলায় পরীক্ষা কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বলেও উপাচার্য জানান।
ড. আমানুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংবিধান, আইন, ভাষা, শিক্ষা, পরিবেশ ও উন্নয়ন ভাবনাসহ উচ্চতর মানববিদ্যা ও যুগোপযোগী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মোট ২২২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৮৭৯টি অনার্স কলেজ (৩৭৫টি সরকারি ও ৫০৪টি বেসরকারি)। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ লক্ষ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, যা দেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭০ ভাগ। অধিভুক্ত কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা তৈরির জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে একাডেমিক এক্সচেঞ্জ ও সহযোগিতামূলক যৌথ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
উপাচার্য আরও জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ৩১টি বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয়। এর সাথে কৃষি, মৎস্য, স্বাস্থ্য ও কারিগরি বিষয়ক শিক্ষা যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি কলেজগুলোতে বিবাহিত ছাত্রীদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার ও ফিডিং সেন্টার স্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সাইকোলজিস্ট নিয়োগের আহ্বান জানান।
বাজেট অনুমোদন:
অধিবেশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৬৯০ কোটি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকার রাজস্ব ব্যয় সংবলিত প্রস্তাবিত বাজেট এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৪১৭ কোটি ০৩ লাখ ১৯ হাজার টাকার সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। উপাচার্যের অভিভাষণের পর কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এ টি এম জাফরুল আযম এই বাজেট উপস্থাপন করেন।
কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এ টি এম জাফরুল আজম জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাক্কলিত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫৬৫ কোটি ৩৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা, ফলে ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা ঘাটতি থাকছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ ২৮৯ কোটি ৩ লক্ষ টাকা পরীক্ষা পরিচালনা খাতে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮৮ কোটি ২৩ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ আনুষঙ্গিক খাতে ৬০ কোটি ৭৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা, পেনশন ও অবসর সুবিধা খাতে ৫১ কোটি ২৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা এবং শিক্ষা আনুষঙ্গিক খাতে ৫০ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত ৯৮৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুনর্বহালের জন্য বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় ৭৮ কোটি ৯০ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা এবং চাকুরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অবসরের কারণে পেনশন ও অবসর সুবিধাদি খাতে ব্যয় ২৮ কোটি ৮২ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে অনুদান পাওয়ার আশা করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
মূল বাজেটের আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৪১৭ কোটি ০৩ লক্ষ ১৯ হাজার টাকার সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এই অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৭২১ কোটি ৬৪ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা, যা সংশোধন করে ৫১২ কোটি ১৯ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিনেট অধিবেশনের অন্যান্য কার্যক্রম:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সিনেট অধিবেশনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোঃ মোখলেস উর রহমান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোঃ লুৎফর রহমান, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ নূরুল ইসলামসহ মোট ৭৭ জন সিনেট সদস্য, আমন্ত্রিত সিন্ডিকেট সদস্যগণ, সিনেট সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন অংশগ্রহণ করেন।
সিনেট অধিবেশনের শুরুতেই জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন সিনেট চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ। জুলাই বিপ্লবের শহীদ এবং শোক প্রস্তাবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সিনেট অধিবেশনের পূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চ্যান্সেলর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামফলক উন্মোচন করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ।