মেজবা রহমান,স্টাফ রিপোর্টারঃ
পৃথিবীর যাত্রা শুরু করার প্রায় প্রথম দিক থেকেই শ্রমিক পেশার উদ্ভব । তাদের হাত ধরেই আজ সেই প্রাচীনকালের পৃথিবীর আধুনিক রুপ এসেছে । প্রতি বছর ধরে মে মাসের আগমনী সুরের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের মে দিবস এলেই শ্রমজীবী মানুষদের রক্তঝরা আর মুক্তির সংগ্রাম নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং রাজ পথের মিছিল-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা পৃথিবী ।
নিউইয়র্ক-ব্রাসেলসের আধুনিক প্রলেতারিয়েতদের বর্ণাঢ্য র্যালির পাশাপাশি বাংলাদেশের আধুনিক শ্রমিক নামের ‘শ্রমদাস’রাও গতানুগতিক শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে দেশের বিভিন্ন রাজপথ। সারাবিশ্বের নিম্ন আয়ের সকল মানুষই ধনাঢ্য লোকদের ধন বানানোর নেপথ্যে কারিগর । গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ক্যাম্পাস এলাকাতেও ছড়িয়ে আছে এমনি শ্রমিক পেশার অনেক মামারা । তাদের অনেকেই সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনীর পরেও বেলা শেষে শিক্ষার্থীদের মনোরঞ্জন যোগাতে সহায়তা করেন । শিক্ষার্থীদের সারাদিনের একাডেমিক হাজারো ব্যস্ততা শেষে মামাদের টঙের চা , চটপটি , শরবত ,পেঁয়াজু ,পাঁপড়সহ মুখরোচক খাবার গুলো যেন আড্ডার রশদ যোগায় । আজ শ্রমিক দিবসে এমনি কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে শুনব তাদের বৈচিত্রময় জীবনের কিছু গল্প ।
হাফিজঃ বশেমুরবিপ্রবি ক্যাম্পাসে এমন কোন শিক্ষার্থী নাই যে হাফিজ মামাকে চেনে না । হাফিজ মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করার প্রথম দিকের একজন চায়ের টঙের মালিক । তার ঘন দুধের সরের সুস্বাদু চা আর অমায়িক ব্যাবহার ,যে কারোরই মন জয় করে নেয় । আজকের শ্রমিক দিবসের ভাবনায় তিনি বলেন, আমি হতে পারি চায়ের দোকানি, কিন্তু সারদিন শিক্ষার্থীদের মাঝে থেকে নিজেকে তাদেরই পরিবারের একজন সদস্য মনে হয় । তাদেরকে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি ।তবে কোনদিন মনমালিন্য হয়নি ।সত্যি দেশের সব যায়গায় যদি নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রতি মানুষ এমনি সহানুভূতিশীল হতো, তবে শ্রেণী বিভাজন বলে কোন কথা থাকতো না ।
শফিকঃ শফিক এর বাসা অনেক দূরে । গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ২০১৮ সাল থেকে ক্যাম্পাসে ব্যবসা করে আসছেন ।প্রথমে ঘৃতকুমারীর শরবত দিয়ে ব্যাবসা শুরু করলেও বর্তমান দোকান নিয়ে ভাঁজা পোড়া খাবারের ব্যবসা করেন । তার মার্জিত ব্যবহার অনেকেরই মন জয় করে নিয়েছে । শ্রমিক দিবসের ভাবনায় তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে দেশের অনেক জায়গায় ব্যবসা করেছি ।তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো এত ভালো ব্যবহার কোথাও পাইনি । বাকী জীবনটাও এই প্রিয় মামাদের সাথে পার করতে চাই । দেশের সব দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের প্রতি সবার সদ্ব্যবহার থাকলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতো ।
তোবারকঃ তোবারক ক্যাম্পাসে দীর্ঘ দিন ধরে পাঁপড় বিক্রি করেন । মূলত তিনি একজন দিন মজুর । প্রতিদিনের মজুরী শেষে ক্যাম্পাসে পাঁড়র নিয়ে আসেন ।শিক্ষার্থীদের বড় এক অংশ মামার পাঁপড়ের ক্রেতা । শ্রমিক দিবসের ভাবনায় তিনি বলেন, প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনী শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্নেদের কাছে আসি, তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় । টাকা নয়, তাদের আন্তরিকতাই মুখ্য । দেশের সব মানুষ যদি শ্রমিকদের প্রতি এমন আন্তরিক হতো , তবে ন্যায্য বেতনের দাবি নিয়ে কাউকে রাস্তায় নামতে হতো না ।
আব্দুস সামাসঃ আব্দুস সামাদ মূলত একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ।বয়সের ভারে ঝুঁকে পরলেও, পরিবারের হাল ধরতে এ বয়সেও ব্যবসা করছেন । শ্রমিক দিবসের তার চিন্তা জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার অনেকদিনের দোকানদারীতে শিক্ষার্থীদের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । তাদের ব্যবহারে নিজেদের সন্তান বলে মনে হয় ।আমি মনে করি দেশের সব দোকানি সহ নিম্ন আয়ের সব মানুষদের সাথে সমাজের সকল পেশার মানুষদের সুসম্পর্ক থাকা উচিত । এতে করে একদিক থেকে যেমন সমাজে শান্তি বয়ে আসবে , ঠিক অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভালো থাকবেন ।
প্রস্নগত, ১৮৮৬ সালের ১মে আমেরিকার শিকাগো শহরের “হে মার্কেটের” শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কর্মদিবস ও নূন্যতম মজুরির দাবিতে সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়েছিল। শিকাগোর সুতাকলের শ্রমিকরা বুকের রক্ত দিয়ে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস আদায় করে । তাদের এই স্মৃতিময় দিনকে সরণীয় রাখতে ও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নে সমগ্র বিশ্বে ১মে ‘মহান শ্রমিক দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।