‘দুই হাজার চব্বিশ সালে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে এসেছি আমরা। জনগণ পুরানা গণবিরোধী সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করবার জন্য অকাতরে শহীদ হয়েছে, সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, নানানভাবে জুলুমের শিকার হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই গণ-অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার জন্য শেখ হাসিনার নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে বহাল রেখে এবং প্রেসিডেন্টের হাতে ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন হয়েছে।
এর পরপরই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা শুরু হয়। আট আগস্টে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান এবং তার গড়ে তোলা পুরা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষা শপথ নিয়ে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করা হয়।
আইন কিংবা রাজনীতি, যে দিক থেকেই আমরা বিচার করি না কেন—গণ-অভ্যুত্থানের পরে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন বৈধ ছিল না। তাহলে অবৈধ সরকারের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেবারও কোনো রাজনৈতিক বা আইনি বৈধতা নাই। সেদিক থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’ কী আছে বা কী নাই সেই তর্ক অর্থহীন। যদি গণ-অভ্যুত্থান এই সরকারের আইনি বৈধতার ভিত্তি না হয়, অন্যদিকে যদি শেখ হাসিনার সংবিধানে যা নাই তেমন ‘অবৈধ’ সরকার গঠন করা হয়, তাহলে সে সরকারের কোনো ঘোষণারই আইনি বা সাংবিধানিক বৈধতা নাই।
অনেকের দাবি, যারা গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. ইউনূসের জুলাই ঘোষণা তাদের সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য ‘দায়মুক্তি’ (Indemnity) করেছে। শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে এবং সেই সংবিধানের অধীনে দায়মুক্তি সম্পূর্ণ অসম্ভব। শেখ মুজিবর হত্যার বিচার এড়ানো যায়নি। অতএব এই দায় এড়ানোর একমাত্র উপায় সংবিধান সম্পূর্ণ বাতিল করা এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা।
অবৈধ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবৈধ। শেখ হাসিনার সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের অধীনে নিবন্ধন পাওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ‘অবৈধ’। অতএব নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নতুন ভাবে নির্বাচন বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া নির্বাচনও সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’।
আমাদের সমাজে সংবিধান, সরকার, রাষ্ট্র, গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও আইনী বর্গ সম্পর্কে ধারণা অতিশয় অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন এবং সমাজে পশ্চাৎপদ পেটিবুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাচেতনারই আধিক্য। তাই সহজ কথা আমরা সহজে বুঝতে চাই না।
ড. ইউনূসের সামনে শেখ হাসিনার সংবিধান বাতিল এবং পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিকল্প নাই। ফ্যাসিস্ট সংবিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তার জন্য অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন আগে করতে হবে এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন সরকার গঠন ছাড়া ড. ইউনূসের সামনে আর কোনো পথ খোলা নাই।
লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক ফয়সালা বা সমঝোতা তাঁকে আগামি দিনে বাঁচাতে পারবে না। তিনি আদতে এস আলমসহ লুটেরা মাফিয়া শ্রেণির সঙ্গে যে সমঝোতা করেছেন তারাই তাকে শেখ হাসিনার সংবিধান দিয়েই শাস্তি দিতে সক্ষম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে বাঁচাতে পারবে না।
ড. ইউনূস, দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকান। নিজেকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবেন না।’