শরিফুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার নড়াইলঃ
ঢাকা বেনাপোল ভায়া নড়াইল লোহাগড়া যশোর মহাসড়কের কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদীর উপর নির্মানাধীন কালনা সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্থ্যাৎ পদ্মা সেতুর সাথেই চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরে এ সেতুর নির্মান কাজ চলছে।
কালনা সেতুর পশ্চিম পারে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা এবং পূর্ব পারে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা। পদ্মা সেতুর চেয়ে দুই লেন বেশি প্রশস্ত এবং দেশের প্রথম ছয় লেন এই কালনা সেতু চালু হলে লোহাগড়া নড়াইলসহ যশোর বেনাপোল খুলনা সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাগামী যানবাহন মাগুরা-ফরিদপুর দৌলতদিয়া আরিচা পার হয়ে যাতায়াতের পরিবর্তে কালনা সেতু পার হয়ে সংক্ষিপ্ত পথে ঢাকা যেতে পারবে। এশিয়ান হাইওয়ে ১ এর অংশ ছয়লেনের দৃষ্টিনন্দন এ সেতু চালু হলে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে।
রাজধানী ঢাকার সাথে বিভাগীয় শহর খুলনার দুরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং যশোরের দুরত্ব ১১৩ কিলোমিটার কমে যাবে। এই সেতু চালু হলে দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে কালনাসেতু হয়ে ঢাকার দুরত্ব হবে ২০১ কিলোমিটার এবং যশোর থেকে ঢাকার দুরত্ব হবে ১৬১ কিলোমিটার। বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে ধলগা বসুন্দিয়া নড়াইল হয়ে ঢাকার দুরত্ব হবে ১৯০ কিলোমিটার।একইভাবে নড়াইলের দুরত্ব হবে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার অর্থ্যাৎ কমে যাবে ১৮০ কিলোমিটার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন ‘ক্রস বর্ডার রোড নেট ওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে’র আওতায় জাইকার অর্থায়নে এ সেতু নির্মান করা হচ্ছে। জাপানের টেককেন কর্পোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের বৃহৎ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিঃ যৌথভাবে সেতু নির্মানের কাজ করছে।
গত সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে- নদীর পূর্ব পাড়ের সংযোগ সড়কের ১৩ টি কালভার্টের ১২টির কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন কার্লভার্টটি পরবর্তীতে সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় করা হচ্ছে। এটির কাজ চলমান রয়েছে। আটটি আন্ডার পাস নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। নদীর পূর্ব পাড়ে টোল প্লাজা নির্মাণ কাজ চলছে। এটি হবে ডিজিটাল টোল প্লাজা। উভয় পার্শ্বে মোট পৌনে চার কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটির কাজ শেষ হয়েছে। পূর্ব পাড়ের সংযোগ সড়কের কার্পেটিং কাজ শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাড়ের সংযোগ সড়কে বালি পাথর দিয়ে সমান করা হচ্ছে। সেতুর একটি পিলারের পানির উপরের অংশের কাজ এবং একটি স্প্যানের কাজ বাকী রয়েছে। সেতুর মাঝখানে ধনুকের মত বাঁকা সুদৃস্য ডিজাইন করা হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘নেলসন লোস আর্চ টাইপের সেত’ু। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে এটি হবে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন এবং প্রশস্ত সেতু। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই অর্থ্যাৎ পদ্মাসেতু চালুর সাথেই কালনা সেতু চালুর লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণ কাজ দিন-রাত দুই শিফটে চলছে। সংশোধিত পরিকল্পনা অনূসারে কালনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। ছয় লেনের এই সেতুতে দ্রুত গতির চার লেনের উভয় পাশে একটি করে লেন কম গতির যানবাহন চলাচলের জন্য থাকবে। সেতু নির্মানে ব্যয় হবে ৯৫৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলে এক নির্বাচনী জনসভায় ক্ষমতায় গেলে কালনা ঘাটে সেতু নির্মাণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কালনা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় মধুমতি নদীর উপর কালনা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্প অনুমোদনকালে ২০১৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হবে বলে উল্লেখ ছিল। এ সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৭০ কোটি টাকা এবং সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ৬৮০ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ১৮.২০ মিটার। তখন কালনা সেতু ছিল চার লেনের। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের পর কালনা সেতুর সাথে রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা ,জমি অধিগ্রহন ইত্যাদি নানা জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়। অবশেষে পৃথক রেল সেতু নির্মাণসহ সব জটিলতা কাটিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ জুন সংশোধিত প্রকল্পে ছয়লেনের সেতু হিসাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তখন প্রকল্পের ৩৬ মাস মেয়াদ ধরে ২০২১ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার সময়ে কাজ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নড়াইল ,যশোর ,খুলনা ,সাতক্ষীরা ,বেনাপোল ,কুষ্টিয়া ,চুয়াডাঙ্গা ,মেহেরপুর জেলাবাসী কালনা সেতু পার হয়ে পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে ঢাকা যাতায়াত সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হবে। এছাড়া স্থল বন্দর বেনাপোলের আমদানী-রফতানি পণ্যাদি পরিবহনেও এই সেতু ব্যবহার করা যাবে।
কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ আশরাফুজ্জামান নবধারা কে বলেন-সব জটিলতা কাটিয়ে সেতু নির্মানের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে মোট কাজের ৬৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মাসেতুর সাথেই চালুর আশা নিয়ে রাতদিন দুই শিফটে কাজ চলছে।