নড়াইলের সদর উপজেলার বিছালী ইউনিয়নের শসা বাজার থেকে প্রতিদিন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শসা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। এটি দেশের অন্যতম বড় শসার পাইকারী বাজার হিসেবে ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে খুব ভোর থেকেই সরগরম হয়ে ওঠে এই বাজার।
সদর উপজেলার বিছালী ইউনিয়নের আড়পাড়া, মির্জাপুর, রুখালী, চাকই, মধুরগাতী, আরাজি মরিচা, আকবপুর, রুন্দিয়া, আটঘরা, বড়াল, কালিনগর, বিছালী, বন খলিসাখালী, সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের নলদীর চর, খলিসাখালী, গোবরা, শুভারঘোপ, বড়গাতী, বড়কুলা, সিংগা, শোলপুর, চুনখোলা, তারাপুর ও কলোড়া ইউনিয়নের বাহির গ্রাম, নিরালী, শিমুলিয়া, আগদিয়া, আগদিয়ার চর, রামনগর চর, গোয়াইল বাড়ী, কলোড়া, বীড় গ্রাম ও মুশুড়ীয়াসহ প্রায় ৩০ গ্রামের কৃষকেরা এই বাজারে শসা নিয়ে আসেন। এখানে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মতো শসা বেচাকেনা হয় বলে জানিয়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা। নড়াইল ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলাসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব শসা সংগ্রহ করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বিছালী ইউনিয়নের ১ ও ২ নং ওয়ার্ডের বর্ণি মোড়বাজার, মালাধারার মোড়, চাকই চৌরাস্তা, আড়পাড়া-মির্জাপুর মোড়, বিছালী, আটঘরা,বড়াল,বনখলিশাখালী গ্রামের প্রধান সড়কের মোড়গুলো ঘিরে বসেছে বিশাল শসার বাজার। প্রতিদিন ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম থাকে এ শসার বাজার। সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে পুরোদমে কেনাবেচা। বেশি সরবরাহ থাকায় দামও অনেকটা যৌক্তিক পর্যায়ে। উৎপাদিত শসা মন প্রতি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক দরদামে কৃষকের নিকট থেকে শসা কিনেন পাইকাররা। এরপর সেগুলো চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে শসা ও ক্ষীরা চাষ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ২৫ হেক্টর বেশি জমিতে শসার চাষ হয়েছে। সদরের তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৩০ গ্রামেই প্রধানত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই শসা ও ক্ষীরা চাষ হচ্ছে। জুলাই মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত শসা লাগানোর উপযুক্ত সময়। আড়াই মাসে শসা তোলা যায়। এ শসা চলবে পুরো ডিসেম্বর মাস। গত দুই মাস আগে শসার পুরো মৌসুমে প্রায় শতাধিক ট্রাকে করে শসা সারাদেশে পাঠানো হয়েছে। এখন প্রতি সপ্তাহে তিনদিনে যাচ্ছে ২০ থেকে ৩০ ট্রাক শসা। প্রতি ট্রাকে ১০ টন শস্য পরিবহন করা যায়। সে হিসেবে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০টন শসা যাচ্ছে সারা দেশে।
মির্জাপুর গ্রামের কৃষক আদিত্য বিশ্বাস বলেন,‘দুই বিঘা জমিতে শসা চাষ করে তার খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। তিন মাসে শসা বিক্রি করেছেন প্রায় লক্ষাধিক টাকা। শসা চাষ করে তিন থেকে গুণ লাভ পেয়েছেন তিনি। পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষের পাশাপাশি পরিচর্যা করলে শসা চাষে অধিক লাভ পাওয়া যায়। গ্রামের কৃষক শুধু আদিত্য বিশ্বাস নন, শসা চাষ করে হাজার হাজার কৃষক লাভবান হয়েছেন।’
আড়পাড়া গ্রামের কৃষক বিশ্বজিৎ গোলদার বলেন,‘পৈতৃকসূত্রে দুই বিঘা জমি পেয়েছি। এই পরিমাণ জমিতে প্রতিবছর জমিতে শসা চাষ করে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা। গত দুই মাসে ৭৫ হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছি। আরও ২৫ হাজার টাকার শসা বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি। উৎপাদন খরচ বাদে তিন মাসে আয় হয় ৭৫ হাজার টাকা।’
বিছালী ইউনিয়নে গড়ে ওঠা কোটি টাকার শসা বাজারের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবতী বলেন,‘বিছালী ইউনিয়নের ১ ও ২ নং ওয়ার্ডের সমন্বয়ে প্রায় ৩ বছর আগে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় শসার বাজার। বাজারে মৌসুমের শুরুতে প্রায় প্রতিদিন কোটি টাকার শসা বেচাকেনা হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০টন শসা ট্রাকযোগে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা,চট্টগ্রাম,সিলেট ও কুমিল্লাসহ সারা দেশে। ভালো বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিরাপদ লেনদেনের সুবিধার জন্য স্থানীয় মির্জাপুর বাজারে ব্যাংক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা গেলে আরও বেশি ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটবে এখানে। পাশাপাশি উৎপাদিত শসা সংরক্ষণ করতে সরকারি উদ্যোগে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলে এখানকার কৃষকেরা উপকৃত হতেন বলে মত দেন তিনি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নড়াইলের উপপরিচালক (ডিডি) দীপক রায় বলেন, ‘ এ জেলার মাটি কৃষির জন্য খুবই উপযোগী। অন্যান্য ফসলের তুলনায় মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষ লাভজনক হওয়ায় এ জেলায় দিন দিন শসা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দুই মাস আগে যখন শসার পুরো মৌসুম শুরু হয়,তখন প্রায় প্রতিদিন অর্ধ শতাধিক ট্রাকে শসা ঢাকাসহ সারাদেশে পাঠানো হলেও এখন প্রতি সপ্তাহে তিনদিন যাচ্ছে ২০ থেকে ৩০ ট্রাকে প্রায় ২০০টন শসা যাচ্ছে সারাদেশে। ঘেরের পাড়ে কম খরচে শসা চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য আমরা চাষিদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। যে কারণে এবছর কৃষকেরা ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে আশাতীত ফলন পেয়ে লাভবান হয়েছেন।