হুমায়ুন কবির মিরাজ, বেনাপোল
বৃষ্টি নামলেই মাটি থেকে উঠে আসে ঘ্রাণ, আর আকাশ থেকে নামে শীতলতা। কিন্তু এই বর্ষায় যা আর আগের মতো দেখা যায় না, তা হলো—কদম ফুল। এক সময়ের বর্ষার অবিচ্ছেদ্য প্রতীক, গোলগাল সাদা-হলুদ এই ফুল এখন শার্শা-বেনাপোল অঞ্চলে প্রায় বিলুপ্তির পথে। কদম এখন কেবল কবিতায়, ছবিতে বা শৈশবের কোনো সোনালি দিনে আটকে আছে।
এক সময় শার্শার নাভারণ, বাগআঁচড়া, কায়বা, শঙ্কারদাহ, রঘুনাথপুর কিংবা বেনাপোলের আমড়াখালি, গরুড়বাড়িয়া, কাস্টম হাউসের আশপাশ—সবখানে চোখে পড়ত কদম গাছ। বর্ষা এলেই রাস্তার ধারে, মাঠের কিনারায়, স্কুলের আঙিনায় ফুটে উঠত শত শত কদম। আজ সেই দৃশ্য একেবারে বিরল।
স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, শুধু সৌন্দর্য নয়, কদমের সঙ্গে ছিল আবেগের সংযোগ। গ্রামের মেয়েরা বর্ষায় কদম ফুল দিয়ে গাঁথতো মালা, তরুণরা দিত ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। এখন সেই ভালোবাসার বাহনটাই হারিয়ে যাচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আব্দুল হালিম বলেন, “ছোটবেলায় আমরা দল বেঁধে কদম ফুল তুলতাম। বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে কদম মালা বানিয়ে মেয়েদের দিতাম। এখন ছেলে-মেয়েরা হয়তো জানেই না এই ফুলটা কেমন ছিল। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা এখন গুগল থেকে ছবি দেখেই চিনে কদম।”
শার্শা উপজেলার নাভারনের পার্শ্ববর্তী রেলস্টেশন এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি কদম গাছ এখনও টিকে আছে। প্রতিবছর বর্ষায় সেখানে দু-একটা ফুল ফোটে, যা আশপাশের মানুষদের স্মৃতিকাতর করে তোলে। অনেকেই ছবি তুলতে যায়, কেউ কেউ ছেঁটে নিয়ে আসে বাড়ির টেবিলে রাখার জন্য।
পরিবেশবিদদের মতে, কদম ফুল শুধু আবেগ নয়, এটি একটি পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ। জলাভূমির ধারে জন্ম নেয় বলে এ গাছ ভূমিক্ষয় রোধে সহায়ক, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। বৃষ্টির মৌসুমে এমন গাছ ভূমি সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
কিন্তু এ গাছের যত্ন হয় না বললেই চলে। অবাধ গাছ কাটা, নগরায়ন, খাল-জলাশয় ভরাট, এবং পরিকল্পনাহীন রাস্তা সম্প্রসারণ—এসব কারণে দিন দিন কদম গাছ কমে যাচ্ছে।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপক কুমার সাহা বলেন,
“কদম আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও পরিবেশের অংশ। স্কুল, কলেজ, সরকারি খাসজমি বা খেলার মাঠে যদি ব্যাপক হারে কদম গাছ রোপণ করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্যদিকে প্রজন্মও পরিচিত হবে নিজের শেকড়ের সঙ্গে।”
প্রকৃতির অনেক উপহার আমরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। কদম এখনো পুরোপুরি হারায়নি—তবে সময় যদি এখনই ব্যবস্থাপনা না নেয়, তবে কদম হয়ে যাবে আরেকটি “কাব্যের স্মৃতি” মাত্র। কদম ফুলকে ফিরিয়ে আনতে চাই স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ, চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা, চাই নতুন প্রজন্মের আগ্রহ।
এই বর্ষায় যখন চারপাশ বৃষ্টিতে ভিজছে, তখন কদম ফুলের অভাব যেন প্রকৃতির সাজে এক অপূর্ণতা হয়ে রয়ে গেছে। সময় এসেছে এই সৌন্দর্য, এই আবেগ আর এই সংস্কৃতিকে আবারও জীবন্ত করে তোলার।