গত রোববার রাতে হঠাৎ করে ঘটা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় ঢাকার বড় একটি অংশ। রামপুরা সুপার গ্রিড সাবস্টেশনে ‘বাজফিড’ নামে কারিগরি ত্রুটির ফলে এ বিভ্রাট ঘটে। এতে গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, ফার্মগেটসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় একযোগে এক ঘণ্টার বেশি সময় লোডশেডিং হয়।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিবিপি) জানিয়েছে, রামপুরা গ্রিডের ২৩০ কেভি সাবস্টেশনে রোববার (২২ জুন) রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। পরে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে মেরামত শেষে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
গ্রিডে হঠাৎ এমন বিপর্যয় দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত ও পরিকল্পনাগত দুর্বলতার চিত্র সামনে এনেছে। সঞ্চালন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের অভাব এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি গ্রিড ট্রিপিংয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘বাজফিড’ কীভাবে ঘটে?
পিজিবিপির প্রধান প্রকৌশলী বি. এম. মিজানুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় গ্রিডে ‘বাজফিড’ হয়েছে, যা মূলত বিদ্যুৎ ফ্রিকোয়েন্সি বা ভোল্টেজের অনিয়মিত ওঠানামার ফলে হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে গ্রিডে চাপ পড়ে। এতে ফ্রিকোয়েন্সি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে সাবস্টেশন নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটিই হলো বাজফিড।
তিনি বলেন, রামপুরা সাবস্টেশনে এই ত্রুটি কীভাবে ঘটল, তা জানতে তদন্ত চলছে। তবে ঘটনা দ্রুত সমাধান করতে পেরেছে পিজিবিপি, এটা ইতিবাচক।
বারবার কেন ঘটছে বিপর্যয়?
দেশে গ্রিড বিপর্যয় নতুন ঘটনা নয়। এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে ঢাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চল ছয় ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। একই বছরের সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা। এছাড়া ২০১৭, ২০১৪ এবং ২০০৭ সালেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটে।
গ্রিড বিপর্যয়ের পেছনে ওভারলোডই প্রধান কারণ
গ্রিড বিপর্যয় সাধারণত বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত লোড, অগ্নিকাণ্ড, ঝড়-বৃষ্টি বা বৈরী আবহাওয়া এবং খুঁটি উপড়ে গিয়ে বিদ্যুতের তার বিচ্ছিন্ন হওয়া।
উন্নত বিশ্বে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়, যা লোড ব্যালান্স করতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড এখনও অনেকাংশে ম্যানুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঞ্চালন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের অভাব এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি গ্রিড ট্রিপিংয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার দিন আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল, ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। সুতরাং আবহাওাজনিত কোনো কারণে গ্রিড ট্রিপ হওয়ার কথা নয়। সম্ভবত অতিরিক্ত লোডের কারণে ট্রিপিং হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি থাকে। ফলে ওভারলোডের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সাধারণত সাবস্টেশনগুলো ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা থাকলে অনেক সময় তার সমান বা বেশি লোড নেয়। তাৎক্ষণিকভাবে তা সমস্যা না করলেও, দীর্ঘ সময় ধরে এই অতিরিক্ত লোড নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিয়ম হচ্ছে নির্ধারিত লোডের চাইতে কিছুটা কম লোড নেওয়া।
বাজফিডের ঘটনায় হয় ‘ক্যাসকেড ট্রিপিং’ও
বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সময় কোনো একটি সাবস্টেশন ট্রিপ করলে অন্য স্টেশনগুলোতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তখন সেগুলোর সুরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে যায় এবং স্টেশনগুলো নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একে একে পুরো গ্রিড সিস্টেম অচল হয়ে যায়- এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ক্যাসকেড ট্রিপিং’।
রোববারের ঘটনার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। রামপুরা সাবস্টেশনে শুরু হওয়া বাজফিড-ঘটিত সমস্যাটি ধীরে ধীরে আশপাশের সঞ্চালন লাইনে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়।
বিদ্যুৎ এখন অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পসহ প্রতিটি খাতের জন্য অপরিহার্য। তাই জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় শুধু জনদুর্ভোগ ঘটায় এমন নয়, এটি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ে দেশের সামগ্রিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে- এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, এ ধরনের ঘটনার জন্য শুধু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা নয়, পিজিবির পরিকল্পনার ঘাটতিও দায়ী। সঠিকভাবে লোড ম্যানেজমেন্ট করা হলে গ্রিডে বাজফিড বা ট্রিপিংয়ের সম্ভাবনা কমে যেত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সঞ্চালন লাইনগুলো ধীরে ধীরে পুরোনো হয়ে পড়ছে, অথচ সেগুলোর ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সঞ্চালন লাইনের আধুনিকায়ন করাটা এখন জরুরি। সেই সঙ্গে যন্ত্রাংশের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও সময়মতো পরিবর্তন নিশ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমে আসবে।