সংবাদ পত্র সমাজের আয়না। আয়না মানুষ খুব শখ করে দেখে, কারণ প্রতিটি মানুষের কাছে তার নিজের চেহারাটাই মূখ্য বিষয়। অন্যকে লোকান্তরে সুন্দর বললেও প্রতিটি মানুষের অন্তরে বিদ্যমান থাকে তার নিজের সৌন্দর্য। তাই সমাজের সব শ্রেনীর মানুষ-ই সুযোগ পেলে আয়নায় নিজের মুখ খানা দেখে নিতে চায়।
ভদ্র সমাজ অথবা শিক্ষিত সমাজের মানুষদের আয়নার প্রতি সব সময়ই একটু বেশী আগ্রহদেখা যায়। প্রায় সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং ভদ্র মানুষদের দেখা যায় পিছন পকেটে একখানা চিরুনী থাকে। সুযোগ পেলেই আয়নার সামনে দাড়িয়ে চিরুনী দিয়ে দেহের সর্বোচ্চ অংশটুকু পরিপাটি করে নেয়। কারণ মানুষ প্রতিনিয়তই নিজেকে অন্যের সামনে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে চায়।
মানুষ যেভাবে সমাজে নিজেকে উপস্থাপন করতে আগ্রহী ঠিক তেমনি ভাবে সমাজের যাবতীয় সমস্যা, সম্ভাবনা, অতিত, বর্তমান ও ভবিষ্যত তুলে ধরার জন্য কাগজে পত্রে ওয়াদাবদ্ধ থাকে মনুষ্যসৃষ্টি একটি মাধ্যম। যাকে সম্পূর্ন সমাজের আয়না বলা হয়। অনেকগুলো বেসরকারি টিভি সেন্টার, নিউজ এজেন্সি, ইন্টারনেট নিউজ পোর্টাল থাকার পরও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ দেশ এবং বিদেশ সম্মন্ধে জানতে পত্রিকার প্রতিই ঝুকে থাকে। আর তাই অনেক পত্রিকার সার্কুলেশন কমে গেলেও পাঠক চাহিদার কারণে প্রতি নিয়তই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পাঠকের দুয়ারে বাড়ছে নতুন পত্রিকার সংখ্যা।
সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সর্বপরী মানবজীবনের দর্পণ এই সংবাদপত্র। সমাজ জীবনে ঢেউ, চমক আর অনিয়ম নিয়েই পত্রিকার অস্তিত্ব। যে কারণে সংবাদপত্রকে প্রতিমুহুর্তে বিশ্লেষণ করতে হয় পাঠকের মানসিকতা। আর এ কারণেই সংবাদপত্রকে প্রতিনিয়ত দাড়াতে হয় পাঠকের কাঠগড়ায়। পাঠকের বিচারশীল মনকে বেঁধে রাখতে হয় রুচি অনুযায়ী খবর পরিবেশন করে। কারণ, এখানেই পাঠকের সুখ, দুঃখ, হাসিকান্না আর স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত হয়। সে জন্যই সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়।
পত্রিকায় লেখনী ও ছবির মাধ্যমে যারা পত্রিকার অবয়ব ভরে তুলে চাহিদা বা রুচি অনুসারে পত্রিকা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সহযোগিতা করে তারা আয়নার কারিগড়। এই আয়নার কারিগড় অবশ্যই গুনাগুণ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি হতে হয়। তাকে সমাজের ভালো মন্দ সব কিছু বিবেচনা করে পত্রিকায় রিপোর্ট অথবা ছবি প্রকাশ করতে সহযোগীতা করতে হয়। যাতে এই রিপোর্ট বা ছবির মাধ্যমে কোন ব্যাক্তির জীবন সংকটাপন্ন না হয়ে পড়ে অথবা সে সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ঘৃনা বোধ না করে। একজন সাংবাদিকের লেখনিতে যেমনি একটি মৃত্যু পথযাত্রী রোগী সমাজের বিত্যবানের সাহায্যে জীবন ফিরে পায় তেমনি একজন সাংবাদিকের লেখনীতে একজন নির্দোষ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে সমাজের সকলের চোখে চরম ঘৃনিত ব্যক্তি। তাই একজন সাংবাদিককে হতে হবে সত্তবাদী, গতিশীল, কৌতুহলী, বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী, গবেষণা দক্ষতা, লেখার দক্ষতা, সাক্ষাতকার নেয়ার দক্ষতা, চিন্তাশীল, যোগাযোগের দক্ষতা, বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে একত্রিত করন, প্রতিশ্রুতিশীল, শৃংখল, আবেগী, চৌকশ, রসিক ও ন্যায়পরায়ণ। এর একটি গুনের সাথে আরেকটি গুন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই একটি বাদ দিয়ে আরেকটিকে আকড়ে ধরে সাংবাদিকতা করা যায়না। এতসব গুনাবলীর মধ্যে প্রথম সত্যবাদীতা যে মানুষের মধ্যে থাকে আমার দৃষ্টিতে সে কোন অন্যায় কাজ করতে পারেনা।
আমি একটি ইংরেজী মাধ্যম পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করি। বাংলা মাধ্যম পত্রিকায় কাজ করার জন্য চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার প্রধান অফিস বরিশালে যাই। সেখানে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা বলি, আমার জেলায় তার পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার অনুমতি পাওয়ার জন্য। তিনি আমাকে সুন্দরভাবে চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সাংবাদিকতার বিষয়ে অনেক কিছু জ্ঞান দিলেন। আমিও সম্পাদককে গুরু মেনে তার কথা “র” চা পানের মতোই গিলছিলাম। তিনি বলেই চলছেন আর আমি শুনেই যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি জানালেন তার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হতে হলে তাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। এই টাকা পত্রিকার এজেন্ট হিসাবে। আবার যখন আমি পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব ছেড়ে দিব তখন এই টাকা আমাকে ফেরত দেয়া হবে। আমি তার কথায় রাজী হলাম। যানতে চাইলাম আমাকে প্রতিনিধি হিসাবে কোন সন্মানী দেয়া হবে কিনা? তার উত্তর ছিল, “না”।
এর পরেই বাতলে দেন অর্থ উপার্জনের পথ। আপনি জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবেন। জেলার বিভিন্ন অফিসে দূর্নীতি রয়েছে। সেখানে যাবেন আমার পত্রিকার কথা বলবেন। বিভিন্ন দূর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করবেন। রিপোর্ট পাঠাবেন, আমাকে ফোনে জানাবেন, আমি রিপোর্ট ছেপে দেবো। পরের দিন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাধ্য করবেন রিপোর্টের বিপক্ষে একটি প্রতিবাদ ছাপানোর জন্য। প্রতিবাদ থেকে প্রাপ্ত টাকার অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার। এরকম প্রতিমাসে ১০ টা প্রতিবাদ পত্রিকায় আনতে পারলেই আপনার ১০ হাজার টাকা আয় হবে। এছাড়া বিভিন্ন অফিসের বিজ্ঞাপন থাকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দূর্নীতিগুলো আমাকে জানাবেন। আমি তাদের সাথে কথা বলবো। আপনাকে বিজ্ঞাপন বা সন্মানী দিতে বলবো রাজী না হলে ওই দূর্নীতিগুলো রিপোর্ট করে পাঠিয়ে দিবেন। এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন অফিস, ভূমি অফিস বিভিন্ন দপ্তর সম্পর্কে তিনি অর্থ আয়ের পথ বাতলে দেন এবং সব শেষে বলেন আপনি চাইলে এভাবেই প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন এবং আমাকেও মাসে ২০ হাজার টাকা দিতে পারেন।
সম্পাদক সাহেবের কাছ থেকে সাংবাদিকতার শিক্ষা গ্রহণ করার প্রায় শেষ পর্যায়ে বরিশালের কোন এক উপজেলা থেকে এক ব্যক্তি এসেছে তার উপজেলায় এই পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে।সম্পাদক সাহেব তাকে বসালেন, তার জন্য চা আনা হল। আমাকে যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক তাকেও একইভাবে তাকেও বলা হল। তিনি ৩ হাজার টাকা সম্পাদকের হাতে দিলেন। পত্রিকার পরিচয়পত্র দেয়ার অনুরোধ জানালে সম্পাদক আরো এক হাজার টাকা নিলেন এবং কম্পিউটার অপারেটরকে হুকুম করলেন এই ব্যাক্তির এখুনি একটি পরিচয়পত্র তৈরী করে দিতে। লোকটি কম্পিউটার অপারেটরের সাথে চলে গেলেন পার্শের রুমে। আমি সম্পাদককে বললাম ওই ভাইতো জীবন বৃত্তান্তের সাথে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেননি। উত্তরে সম্পাদক সাহেব বললেন, ওটার দরকার নেই। উনি কাজ করবেন ইচ্ছে পোষণ করেছেন, টাকা দিয়েছেন, নিয়োগ হয়ে গেছে। সম্পাদক সাহেব ঠোটের কোনে হাসি রেখে আমার কাছে জানতে চাইলেন আপনি টাকা দিবেন? আমি না বলায় উনি খুব কষ্ট পেলেন এবং আমার প্রতি চোখের চাহনীতে একটু বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন, ভাই তাহলে আজ আর কথা হবেনা। আমার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে যান পরে মোবাইলে কথা বলেন। আমি ওনার ভিজিটিং কার্ডটি হাতে নিয়ে দেখি তাতে ইংরেজী ভাষায় জার্নালিষ্ট শব্দটি লেখা ভূল। জে, ও, ইউ, আর এর পরিবর্তে জেএআর দিয়ে জার্নালিষ্ট শব্দটি লেখা রয়েছে। সম্পাদক ভাইয়ার কার্ডে লেখা ভুলটি ধরিয়ে দিতেই উনি বললেন প্রায় ৬ মাস আগে কার্ডগুলো ছাপিয়েছি। বোঝেনতো বরিশালের ছাপা কারখানায় যারা কাজ করে ওরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত তাই এই অবস্থা। জানতে চাইলাম তাহলে কেহই কি এই ভূলটি ধরিয়ে দেয়নি। উত্তরে বললেন সাংবাদিকদের অনেক ভূল থাকে যা সাধারণ মানুষ কেন অনেক এমপি, মন্ত্রীরাও ধরেনা।
সালাম দিয়ে দোতলা অফিস থেকে নিচে নেমে আসলাম। পার্শের চায়ের দোকান থেকে চা খাবো বলে বসার সাথে সাথে গৌরনদীর লোকটিতে দেখতে পেলাম। আগ্রহ ভরে নিজেই দুয়েক বাক্য বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম এইচ এস সি সম্পন্ন করেছেন কোন বছরে। উত্তরে তিনি বললেন, ভাই সাংবাদিকতা করতে পরাশুনা লাগেনা বলেই তিনি চলে গেলেন।
আমার আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট উপজেলায় আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে ফোন দিয়ে নতুন এই সাংবাদিক ভাইয়ের সম্মন্ধে খোঁজ নিতে চাইলাম। তিনি ২ দিন পর আমাকে জানালেন এই লোক ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে ২ বার এস এস সি পরিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বন্দরে ব্যবসা শুরু করেন। গত বছর মাদক সহ প্রশাসনের হাতে ধরা পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা ভোগ করেন যা প্রায় আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়। তিনি ওই সময় সংবাদ প্রেরনকারী সাংবাদিকদের দেখে নেয়া ও তার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্যই সাংবাদিকতায় নাম লিখিয়েছে বলে আমার সাংবাদিক বন্ধু মন্তব্য করেন।
হায়রে সাংবাদিকতা! সেলুকাস!!…………………
২৫ মে, ২০১৫
মোঃ আসাদুজ্জামান আসাদ
লেখক ও সাংবাদিক
নবধারা/বিএস